ওরা এগারো জন। দেশের স্বার্থে বড় কোন অসাধারণ কর্মযজ্ঞে এদের কোন ভুমিকা না থাকলেও এ ১১ জনের রয়েছে মানুষ থেকে সর্বস্ব লুটে নেওয়ার প্রতিভা। বাস ও ট্রেন যাত্রীদের নিঃস করে পথে বসিয়ে তার মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপনে থাকাটা ছিলো তাদেও কৌশল।
চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস, পাহাড়তলী ও জেলার সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, লাকসাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় সুযোগ বুঝে বাস ও ট্রেনযাত্রীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্যরা। যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ও ল্যাপটপসহ দামী জিনিসপত্র লুট করে নিমিষেই পাহাড়ের গুহায় জাদুকরের মতোই হারিয়ে যায় এ ডাকাত চক্রটি।
ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা অভিযানেও তাদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। তবে গত ২ থেকে আড়াই মাস আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া এ ডাকাতচক্রের কয়েকজন সদস্যের কাছ থেকে পুলিশ বেশ কিছু তথ্য পায়। তথ্যের ভিত্তিতে গত দুমাসে জামিনপ্রাপ্ত ডাকাত দলের সদস্যদের উপর পুলিশ নজরদারি বাড়ায়।
আর পুলিশের নজরদারির জালে আটকা পড়ে চক্রের ১১ সদস্য। শনিবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার টাইগার পাস এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওরা ১১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ডাকাতদের মধ্যে দুইজন ‘গরীবের ডাক্তার’ খ্যাত সীতাকুণ্ডের আলোচিত চিকিৎসক শাহ আলম হত্যার আসামী।
এসময় তাদের কাছ থেকে কাঠের বাটযুক্ত লোহার তৈরী দুটি দেশীয় এলজি, দুটি কার্তুজ, ২ টি কালো রংয়ের টিপ ছোরা, ১ টি লোহার তৈরী ছেনি, ৬ টি কাঠের বাটযুক্ত কিরিচ, ১ টি সাদা রংয়ের পিকআপ (ঢাকা মেট্রো-ঠ- ১১-২১৯১) ও ১টি সিলভার রংয়ের প্রাইভেট কার (চট্টমেট্রো-খ-১১-০১৫০) জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, সীতাকুণ্ড জলিল টেক্সটাইল কুতুব মেম্বার বাড়ির শো. শফির ছেলে মো. সালাউদ্দিন (২৪), ভোলা জেলার চরফ্যাশন গোর আলা মুক্ষি বাড়ির নুরনবী সিকদারের ছেলে মো. রাজু (১৯), কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম বাসন্ডা পশ্চিম পাড়ার মৃত মো. ফরিদের ছেলে ইসরাফিল হোসেন আলম (২২), নোয়াখালী জেলার সোনাইমুরি নাটোর শহরের মৃত আলী আহাম্মদের ছেলে মো. আকবর হোসেন (২২), জি বাড়িয়া নবীনগর জাফরপুর জব্বার পুলিশের বাড়ির মো. কামালের ছেলে মো. সেলিম (২৮), নোয়াখালী মাইজদি নালা নগরের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো. টিটু (২৫), সীতাকুণ্ড উপজেলার ইমাম নগরের কাশেম মাস্টার বাড়ির ইব্রাহিমের ছেলে মো. ইয়াসিন (২৩), কুমিল্লা চান্দিনার জোয়ার হালাল বাড়ির মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে মো. ফজর আলী (৩৫), নগরীর আকবর শাহ থানা মিরপুর আবাসিকের রাজা কমিশনারের ভাড়াটিয়া আব্দুল মালেকের ছেলে মো. সুমন (২৫), নোয়াখালি সুধারামপুর সুন্দরপুরের চেয়ারম্যান বাড়ির মো. মানিকের ছেলে মো. রহিম প্রকাশ হৃদয় (২২) ও কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের দাউদপুর মজুমদার বাড়ির মৃত আবুল কালামের ছেলে মো. পলাশ হোসেন (২৫)।
শনিবার দুপরে নগরীর মোমিন রোডে মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরেন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) শাহ মো.আব্দুর রউফ, এসি কোতোয়ালি নোবেল চাকমা। এর আগে শনিবার সকালে নগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসিন ওরা ১১ জনের গ্রেফতার তথ্যটি নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান বলেন, গ্রেফতারের পর ওরা ১১ জনই চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকায়, সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলায়, মিরসরাই, ফেনীর মহিপালে, নোয়াখালী, লাকসাম ও কুমিল্লাসহ অন্তত দুশটি ডাকাতির ঘটনার কথা স্বীকার করেছে।
তিনি বলেন, ডাকাতরা প্রতিদিন ভোরে প্রাইভেট কার ও পিকআপ ভ্যান নিয়ে নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। দোকান ও প্রতিষ্ঠান টার্গেট করতো। দোকান ভাঙার বিভিন্ন সরঞ্জাম সাথে নিয়ে রাতে টার্গেটকৃত দোকান বা প্রতিষ্ঠানের তালা কৌশলে ভেঙ্গে সব লুট করে পালিয়ে যেতো।
এছাড়াও এ ডাকাত দলের সদস্যরা বাস বা ট্রেনের সময়সূচি টার্গেট করে পাহাড়ের কাছাকাছি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে অবস্তান করতো। সময় সুযোগ বুঝে ঝাপিয়ে পড়ে যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নিয়ে আবার পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতেন।
পুলিশ কর্মকর্তা মেহেদী বলেন, আড়াই বছর জেল কেটেছে এদের দলনেতা মো. সালাউদ্দিন। সম্প্রতি সে জামিনে বেরিয়ে ফের ডাকাতি চক্রের লিড দিচ্ছে। কোতোয়ালি থানা পুলিশের বিচক্ষনতায় অস্ত্র ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পিকআপ ভ্যান এবং প্রাইভেটকারসহ এ চক্রের ১১জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মোহসিন জানান, সশস্ত্র ডাকাত দলটি ডাকাতির উদ্দ্যেশে পিকআপ ও একটি প্রাইভেটকার নিয়ে নগরীর টাইগারপাস এলাকার জসিমের চায়ের দোকানের সামনে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবরে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার সময় অভিযানে যায় কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি টিম। এসময় পুলিশের গাড়ি দেখে ডাকাতদল তাদের ব্যবহৃত গাড়িসহ পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ঘেরাও করে গাড়িসহ তাদের গ্রেফতার করে।
ওসি বলেন, গ্রেফতারকৃতরা শুধু ডাকাতি নয় তারা ছিনতাই কাজেও খুব পারদর্শী। এরা প্রতিদিন ভোরে বাস ও ট্রেন যাত্রীদের কাছ থেকে ছিনতাই করে থাকে। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন নির্জন সড়কে অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের রিকশা ও সিএনজি আটকে তাদের দামী জিনিসপত্র হাতিয়ে নেন। এমনকি তাদের সাথে থাকা পাসপোর্ট ও ভিসাও হাতিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে তা ফেরৎ নিতে বিকাশের মাধ্যমে টাকাও আদায় করেছে বলে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছে।
ওসি মো. মোহসিন বলেন, সম্প্রতি নগরীর টাইগারপাস মোড়ে প্রাইভেট কার ব্যবহার করে দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনার সূত্র ধরে শনিবার মধ্যরাতে চক্রটির অবস্থান নিশ্চিত করে অভিযান চালিয়ে ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
এদের মধ্যে সীতাকুণ্ড জলিল টেক্সটাইল কুতুব মেম্বার বাড়ির শো. শফির ছেলে মো. সালাউদ্দিন (২৪) ও নোয়াখালী মাইজদি নালা নগরের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো. টিটু (২৫) সীতাকুণ্ডের আলোচিত ডা. শাহ আলম হত্যাকাণ্ডের আসামি। সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের বরাতে এ তথ্যটিও নিশ্চিত করেন কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মোহসীন।
Leave a Reply