প্রথমে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন, এরপর সেখান থেকে থানা এলাকায় দায়িত্বরত বিভিন্ন কর্মকর্তার নম্বর নিয়ে পুলিশের এসপি অথবা অ্যাডিশনাল এসপি হয়ে কথা বলে পাঠান স্থানীয় বিকাশ নগদের এজেন্টদের কাছে। ওই কর্মকর্তার মোবাইল দিয়েই কথা বলেন দোকানির সঙ্গে, নেন তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর। এর কিছুক্ষণ পরই ফেলা হয় প্রতারণার জাল। এবার সরাসরি ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে দিয়ে পাঠানোর কথা বলে অফিশিয়াল কাজে’ বিভিন্ন নম্বরে কয়েক ধাপে হাতিয়ে নেন টাকা। এভাবে পুলিশকে প্রতারণার ‘হাতিয়ার’ বানিয়ে নওগাঁয় বসে চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়ে নিচ্ছিলেন লাখ লাখ টাকা।
শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) নওগাঁ জেলার মান্দা থানার বাংড়ার মোহনপুর এলাকা থেকে ‘এসপি-এডিশনাল এসপি’ পরিচয়ে বিকাশ এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর উঠে এসেছে পুলিশকে হাতিয়ার বানিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতার গল্প।
গ্রেপ্তার ওই প্রতারক হলেন মো. সাগর ওরফে রিমন। পড়ালেখা খুব বেশি দূর গড়ায়নি; তবে কণ্ঠ শুনে মনে হবে তিনি অনেক বড় অফিসার। আর তার সেই কণ্ঠের জালে ফেলেই পুরো প্রতারণার ছক।
শনিবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরের দামপাড়াস্থ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের সাইবার ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. লিয়াকত আলী খান।
এর আগে, এমন প্রতারণার শিকার হন চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী এলাকার বিকাশ এজেন্ট মিনহাজ উদ্দিন। পরে গত ২৭ নভেম্বর সিএমপির সদরঘাট থানায় এজাহার দায়ের করলে অভিযানে নামে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের সাইবার ইউনিট।
রিমন ওই এলাকার মো. হাসানের ছেলে। তিনি পেশায় একজন গাড়িচালক। তার এলাকায় ভাড়ায় নেওয়া টেম্পু চালান।
উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে টার্গেট করে এসপি-এডিশনাল এসপি পরিচয় দিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কল দিয়ে ওই এলাকার পুলিশ অফিসারের নম্বর চান। পরে তার নম্বরে কল দিয়ে ওই কর্মকর্তাকে বলেন তার আশপাশের বিকাশ এজেন্টের দোকানে যেতে। আর ওই পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে সেই এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে তার নম্বর নিয়ে রাখেন এবং ওই বিকাশ এজেন্টকেও একইভাবে নিজেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় দেন। পরে কথিত এসপি-এডিশনাল এসপি ওই বিকাশ এজেন্টকে ফোন করে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়।’
‘চট্টগ্রামেও তেমনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে এক সার্জেন্টকে কল দিয়ে একটি দোকানে পাঠায়। সাার্জেন্ট ওই দোকানে যাওয়ার পর সেই দোকানদারের সঙ্গে এসপি-এডিশনাল এসপি পরিচয়ে দিয়ে ফোনে কথা বলে। পরে ওই সার্জেন্ট দোকান থেকে চলে এলে বিকাশ এজেন্টকে ৪ দফায় কল দিয়ে ৫১ হাজার ৫শ’ টাকা হাতিয়ে নেয়।’
তিনি আরও বলেন, এসপি-এডিশনাল এসপি পরিচয় দেওয়া রিমন পেশায় একজন গাড়িচালক। তার এলাকায় ভাড়ায় চালিত টেম্পু চালায়। তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই। তবে সেই নিজের ভয়েস দিয়ে ভালোভাবে কথা বলতে পারে। শুধু সে একা নয়; তার সঙ্গে আর কয়েকজন জড়িত আছে। এরমধ্যে কেউ কল দেয়, কেউ টাকা ক্যাশ আউট করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এ ধরনের প্রতারণার কাজ করে আসছে। এছাড়া ৪৮৩ জন পুলিশ অফিসারের নম্বর ব্যবহার করে সে এসব কাজগুলো করে আসছে। পুলিশের জন্য তার নিজের এলাকা রাজশাহী-নওগাঁয় করতে না পেরে সে এখন চট্টগ্রামকে টার্গেট করেছে। আর তার ধারণা ছিল, রাজশাহী বসে চট্টগ্রামে এমন প্রতারণা করলে তাকে কেউ ধরতে পারবে না।
তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বিকাশ প্রতারণার ৩টি এবং মাদক সংক্রান্ত মামলার ২টি। এছাড়া তার চক্রের সঙ্গীয় কেউ জেলে আর কেউ বাইরে। প্রতারক চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের সাইবার ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. লিয়াকত আলী খান।
প্রতারণার শিকার চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী এলাকার বিকাশ এজেন্ট মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘দোকানে হঠাৎ একজন সার্জেন্ট আসেন। ওই সার্জেন্টের মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে একজন আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি নিজেকে এডিশনাল এসপি পরিচয় দেন এবং নম্বর নেন। পরে দোকানে আসা সার্জেন্ট চলে গেলে কিছুক্ষণ পর একটি নম্বর থেকে কল আসে। তখন তিনি আবারও এসপির পরিচয় দেন এবং বলেন কিছু টাকা পাঠাতে হবে একটা নম্বরে। আর টাকা সার্জেন্টের দিয়ে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু এভাবে ধাপে ধাপে ৫১ হাজার ৫শ’ টাকা নিয়েছেন।’
Leave a Reply