সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবারও জনগণের সেবা করার সুযোগ দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, দীর্ঘ চলার পথে যতটুকু অর্জন, তার সবটুকুই আপনাদের সহযোগিতা, আপনাদের অবদান। চলার পথে কোনো ভুলভ্রান্তি করে থাকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। আবারও সরকার গঠন করতে পারলে ভুলগুলো শোধরাবার সুযোগ পাব। তাই নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।
বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া নির্বাচনী ভাষণে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার এই ভাষণ গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন একযোগে সম্প্রচার করে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ছাড়াও এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আরও ১৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রধান বা প্রতিনিধিরা নির্বাচনী ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনো উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না, ইন্ধন জোগাবেন না।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ’৭৫-পরবর্তী চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে সাফল্যের সঙ্গে বর্তমান মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে। এ জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর থেমে যায় বাংলাদেশের সব উন্নয়ন অগ্রগতি।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন এবং দীর্ঘ ছয় বছর শরণার্থী হিসেবে তাঁর ও ছোট বোন শেখ রেহানার প্রবাসে কাটানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, তৎকালীন সামরিক শাসক আমাদের দেশে আসতে বাধা দেয়। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ ও জনগণের সমর্থন নিয়ে আমি দেশে ফিরে আসি। অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন সরকার, জাতির পিতার হত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী এবং যুদ্ধাপরাধী সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আমি দেশে ফিরে আসি। শুরু করি জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জন্য বারবার আমার ওপর আঘাত এসেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, বারবার গ্রেপ্তার হয়েছি। আমাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। অবশেষে মানুষের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হই। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। অবসান হয় হত্যা, ক্যু ও সামরিক শাসনের।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে অত্যাচার-নির্যাতন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতি-লুটপাটের বিবরণ তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচন দেওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে থাকে। নির্বাচনে কারচুপির উদ্দেশ্যে এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারসমেত ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠন করে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে অন্ধকারের পথে ধাবিত করে। ফলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। সামরিক বাহিনী অন্তরালে থেকে ক্ষমতা দখল করে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন, মইন উদ্দিনের এই সরকার জনগণের অধিকার হরণ করে তাদের ওপর স্টিম রোলার চালানো শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়। আমাকে ও আমার দলের বহু নেতাকর্মীসহ অন্য দলের নেতাকর্মীকে বন্দি করা হয়। ভিন্ন দল গঠন করার চেষ্টা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়।
তিনি বলেন, তাদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সচেতন দেশবাসী রুখে দাঁড়ায়। জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা নবম সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। তবে নির্বাচন সংস্কারের যে দাবি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট উপস্থাপন করেছিল, সেগুলো থেকে তারা কিছু বিষয় কার্যকর করে। যেমন– ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকা বাতিল এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে।
১৯৯৬ সালের প্রথম মেয়াদসহ মোট চার মেয়াদে দেশ ও জাতির কল্যাণে তাঁর সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা সমালোচনা করেন দুঃখের বিষয়, তারা সঠিক তথ্যটা জাতির সামনে তুলে ধরেন না। দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা তাদের চরিত্র। মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি দেখলে তারা বিমর্ষ হয়ে পড়েন।
এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আজ আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে হাজির হয়েছি। এই উন্নয়নকে টেকসই করা, আপনাদের জীবনমান উন্নত করা, প্রিয় মাতৃভূমিকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ চাই। আপনাদের মূল্যবান ভোটে নির্বাচিত হয়ে আরেকটিবার সরকার গঠন করতে পারলে আমাদের গৃহীত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে আপনাদের জীবনমান আরও উন্নত করার সুযোগ পাব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ধারা ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে জনকল্যাণমুখী ও সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের পথে জাতিকে অগ্রসর রেখেছে।
তিনি বলেন, ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার যে সুযোগ পাওয়া যাবে, তা কার্যকর করা এবং যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই মোকাবিলা করতে পারবে। এর মাধ্যমে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। সম্ভাবনাময় বিশাল তরুণসমাজ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের মূল কারিগর। তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি, সংঘাতে নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’– এই নীতিতেই আমরা বিশ্বাস করি। এই নীতি নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সংগ্রাম করেছেন এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। আমি বাবা-মা, ভাই– সব হারিয়ে দুঃখ-বেদনাকে সম্বল করে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের মাঝে খুঁজে পেয়েছি আমার বাবার স্নেহ, মায়ের মমতা এবং ভাইয়ের মায়া। আপনারাই আমার পরিবার, আমার ওপর ভরসা রাখুন। আসুন, সবাই মিলে এই বাংলাদেশকে স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নপূরণ করি।
তিনি বলেন, কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই– ‘আমাদের ডাক এসেছে/ এবার পথে চলতে হবে।/ ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে/ বিশ্ব পথে সবার সাথে সমান তালে।/ পিছন পানে তাকাসনি আজ, চল সম্মুখে/ জয়ের বাণী নূতন প্রাতে বলও-মুখে।’
Leave a Reply