লাখে ভক্তের আগমনে মুখরিত মাইজভান্ডার দরবার শরীফ

চলরে মন ত্বরায় যায় বিলম্বের আর সময় নাই, গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী স্কুল খুলেছে….. একতারা, দোতারা, হারমোনি, তবলার তালে তালে কনকণে শীত উপেক্ষা করে মাইজভান্ডারে আশেক-ভক্তের ঢল নেমেছে। আশেক, ভক্ত, অনুরক্তরা আসছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। সাথে সবুজ পতাকা ও ব্যানারে তরিক্বতের বিভিন্ন বানী। আল্লাহ, রাসুল (দ.) ও মাইজভান্ডারী তরিক্বতের শ্লোগান। সাথে স্বীয় পীর মুরশীদের দরবারে গরু, ছাগল, মহিষ, উঠ, গয়াল সহ আরো কত কি…..।

মাইজভান্ডারী দরবার শরীফের আধ্যাতিক সরাপতের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হযরত মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আহমদ উলাহ মাইজভান্ডারী (ক.) ১১৮তম বার্ষিক ওরশ শরীফ বুধবার (মহান ১০ মাঘ)। গত ২-৩দিন পূর্ব থেকে দেশ-বিদেশের লাখো ভক্তের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে মাইজভান্ডার শরীফে।

বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিটে আনজুমানে মোত্তাবেইনে গাউছে মাইজভান্ডারী শাহ এমদাদীয়া মঞ্জিলের শাজ্জাদানশীন শাহসূফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ), দরবারে-গাউছিয়া আহমদিয়া মনজিলের সাজ্জাদানশীন ডা. সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ), সাজ্জাদানশীন সৈয়দ শহিদুল হক মাইজঅবন্ডারী (ম.জিআ), মাইজভান্ডার গাউছিয়া হক মনজিলের সাজ্জাদানশীন সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ), সৈয়দ মুনিরুল হক মাইজভান্ডারী (র.) শাহজাদাদ্বয় মুন্তাজেম সাজ্জাদানশীন সৈয়দ আহমদ হোসাইন শাহরিয়ার মাইজভান্ডারী (মজি.আ) এবং সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ) এর আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে ওরশের আনুষ্টানিকতা শেষ হবে। এ উপলক্ষ্যে ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন ও ফটিকছড়ি থানা পুলিশ ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে।

পটভূমি:
সৈয়দ হামিদ উদ্দীন গৌড়ী ১৫৭৫ সালে ইসলাম প্রচার মানসে চট্টগ্রামে আগমন করে পটিয়া থানার কাঞ্চননগরে বসতি স্থাপন করেন। তারই বংশধর মাওলানা সৈয়দ মতিউলাহর সৈয়দ মতিউলাহর পবিত্র ঔরসে ১৮২৬ সালে, হিজরী ১২৪৪, ১২৩৩ বাংলা ১ মাঘ, বুধবার জোহরের সময় হযরত শাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উলাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) জন্ম গ্রহন করেন। ১২৬০ হিজরিতে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা গমন, ১২৬৮ হিজরিতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেন এবং হাদিস, তাফসির, ফেকাহ ইত্যাদি শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। ১২৬৯ হিজরিতে যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরিতে সেই কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতার মুন্সি বু-আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদাররেস পদে যোগদান করেন। তার পীর গাউছুল আজম মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জীলানীর (রহ.) বংশধর শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহ.) এর নিদের্শে ১৮৫৭ সালে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে ফিরে আসেন।

কিছুদিনের মধ্যেই তার কামালিয়তের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঐশী-প্রেম পিপাসু সাধক ও দোয়া প্রত্যাশীদের ভিড়ে এই সাধকের পবিত্র বাসগৃহ আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় মাইজভান্ডার দরবার শরিফ হিসেবে। তিনি একমাত্র বাঙ্গালী সূফী সাধক। যিনি বাংলার জমিনে স্বতন্ত্র এক তরিকা প্রতিষ্টা করেন। যার নাম মাইজভান্ডারী তরিকা। ৭৯ বছর বয়সে ১৯০৬ ক্রিস্টাব্দে ১০ মাঘ সোমবার রাতে ইহধাম ত্যাগ করেন এ মহান সুফি সাধক। তার ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮, ৯ ও ১০ মাঘ ৩ দিনব্যাপী ওরশ শরিফ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ-বিদেশের লাখ-লাখ আশেক-ভক্তের সমাগম ঘটে।

মঙ্গলবার মাইজভান্ডার শরীফ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি বছরের ন্যায় ১০মাঘ মাইজভান্ডার শরীফের ওরশ উপলক্ষ্য করে মাইজভান্ডারের ৩/৪ মাইল এলাকায় বিশাল মেলা বসেছে। এতে কৃষি ব্যবহার্য্য পণ্য, কুঁটির শিল্প উৎপাদিত পণ্য, গ্রামীণ গৃহস্থালী সামগ্রী, ডালা, কুলা দা, বটি, বেলুণ, কাঠের পিড়া, মোড়া, পিটা তৈরীর বিভিন্ন চাচ, চুড়ি, বাশি খেলনা, মোলা-ওড়া ইত্যাদিবেশ বিকিনিকি হচ্ছে।

এদিকে ১০মাঘ ওরশ উপলক্ষ্যে ফটিকছড়ি উপজেলা ও থানা প্রশাসন ব্যাপক আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রনের প্রস্তুতি নিয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক সমন্বয় সভায় গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর মাজার ও মাইজভান্ডার শরীফ এলাকায় ক্লোজ-সার্কিট ক্যামরার মাধ্যমে সার্বক্ষনিক নজরদারি করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন রাখা, নাজিরহাট নতুন রাস্তার মাতায়, ফটিকছড়ি সদরে ও নানুপুর লায়লা-কবির কলেজ মাঠে যানবাহন পার্কিং, স্ব স্ব মনজিলের ব্যবস্থাপনায় লাইটিং করা, মাইজভান্ডার পুকুর আবর্জনা মুক্ত রাখা, প্রয়োজনীয় পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, স্ব-স্ব মনজিলের পোষাক পরা সেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা, মহিলাদের চলাচলের স্থানে মহিলা সেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা, আযানের সময় সকল প্রকাল মাইকিং বন্ধ রাখা, নির্দিষ্ঠ সময়ের পরে গরু-মহিষ হাদিয়া প্রবেশ বন্ধ রাখা, পর্যাপ্ত পরিমানে ভ্রাম্যমান স্যানিটেশন ব্যবস্থা করা, গুরুত্বপূর্ণ সিধান্তের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাসহ সব সবস্থানে পুলিশি টহল জোরদারকরা, সকল প্রকার যোগাযোগের জন্য একটি তথ্য কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দরবারে গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের শাহজাদা সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনন সোহেল মাইজভান্ডারী জানান, গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর ওরশে শরীফে বংলাদেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চল ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা, ইরাক, ইরান, তুরষ্ক সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও ধর্মপ্রাণ মুসলমান সহ লাখো সুফী ভক্ত-আশেকগণের সমাগম ঘটে। আমরা ১০দিন ব্যাপী হযরতের মানবিক গুনাবলীর সমন্বয়ে মানবিক ও সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছি।

শাহ এমদাদীয়ার নায়েবে শাজ্জাদানশীন সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভান্ডারী জানান, গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর ওরশে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাখো ভক্তের সুবিধাত্বে থাকা-খাওয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা, নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য লাইটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)র জীবনী, শান-মান সম্ভলিত বিশেষ ক্রোড়পত্র বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থা হয়েছে।

ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ১০মাঘ ওরশ উপলক্ষে পূলিশ ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইন- শৃংখলা রক্ষায় থানা পুলিশ-র‌্যাব-আনসার ও দুই সহস্রাদিক বিশেষ সেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়োজিত থাকবে।

উল্লেখ্য, মাইজভান্ডারের প্রতিটি মনজিল এবছর ১
মাঘ থেকে ১০ দিন ব্যাপী মাইজভান্ডারী তরিকার মানবিক শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা, সামাজিক কর্মকান্ড, এবাদতবন্দেগী, মাইজভান্ডারী সেমা মাহফিলসহ ব্যাপক আয়োজন করেছে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *