ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত কর্মকর্তাদের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘কার কী ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা কিন্তু জানি। যাদের কোনও মোরালিটি নেই তাদেরকেই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। আর সেই মানুষগুলোই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভোটে ইভিএম এনেছে, যে ইভিএমকে ইচ্ছে মতো ম্যানিপুলেটেড করা যায়।’
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক আলোচনা সভায় তিনি এ অভিযোগ করেন। ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী হেল্প সেল’ এর উদ্যোগে বিগত আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের হাতে গুম, হত্যা, পঙ্গু হওয়া নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে এ অনুষ্ঠান হয়।
এতে গুম হওয়া ১০ পরিবারের সদস্যদের হাতে শিক্ষাবৃত্তি হিসেবে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে, এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু আমরা জানি। কে গাড়ির অনুমোদন নেয়ার জন্য ফাইল বদল নিয়ে মন্ত্রীর কাছে গেছেন, কারা নিজের স্কুল পারমিশন নেয়ার জন্য সরকারি জমি নিয়েছেন-এসব খবর আমাদের কাছে আছে। তারপরে দেখা যাচ্ছে, এসব মানুষগুলোকে যাদের কোনো মোরালিটি নেই, তাদেরকে নির্বাচনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের দিয়েই আবার নতুন যন্ত্র ইভিএম মেশিন আনা হয়েছে। যে মেশিন পৃথিবীর সমস্ত দেশে রিজেক্টটেড হয়ে যাচ্ছে, সেই মেশিনে কখনোই ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে না। কারণ ইভিএমকে ম্যানিপুলেটেড করা যায়।’
ইভিএমের বিরোধিতা করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা এর বিরেধিতা করেছি। আমরা বলেছি যে, ইভিএম দিয়ে কখনোই মানুষের যে রায়, তার প্রতিফলন হবে না। আমরা এখনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর বিরোধিতা করছি। গতকাল চট্টগ্রামে উপনির্বাচন হয়েছে। ভোটারদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতেই দেয়নি। তার আগেই বোমা মেরে লাঠিসোটা দিয়ে ভোটারদের তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরে জিজ্ঞাসা করেন বলবে যে, আপনারা পারেননি। পারবো কোত্থেকে? গুন্ডামি আর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যারা করে তাদের সঙ্গে ভদ্রলোকেরা সাধারণ মানুষেরা পারবে কোত্থেকে। দ্যাটস দ্যা রিয়েলিটি। যারা ভোটার তারা তো মারামারি করে না। তারা তাদের অধিকারটা প্রয়োগ করতে যায়, সেটা প্রয়োগ করতে দেয়া হয় না।’
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তারা আজকে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। এমন একটা সমাজ তৈরি করছে, এমন একটা রাষ্ট্র তৈরি করছে যে সমাজ এবং রাষ্ট্র এদেশের মানুষের ভবিষ্যতকে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা সেজন্য বলি যে, বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। তারপরও বলি, হতাশ হবেন না, ছেড়ে দেবেন না। নেভার গিভ আপ। যত কষ্ট আসুক, যত যন্ত্রণা আসুক, যত অত্যাচার-লাঞ্ছনা আসুক এদেশের মানুষ বার বার উঠে দাঁড়িয়েছে, তরুণরা উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবে, দাঁড়াচ্ছে। সব জায়গায় প্রতিরোধ হচ্ছে, প্রতিরোধ হবে।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে বর্তমানের সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে আমরা এই আক্রমণের স্বীকার হচ্ছি। আওয়ামী লীগ যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বে সংগ্রাম করেছিলো, গণতান্ত্রিক লড়াই করেছিলো তারাই স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে দানবে পরিণত হয়েছে। একবার তারা ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলো। সেটা করতে যাওয়ার আগে তারা একইভাবে এদেশের দেশপ্রেমিক হাজার হাজার তরুণ-যুবককে হত্যা করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের পরে তারা একইভাবে শুধু খোলসটা পাল্টিয়ে ভিন্ন আঙিকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে, নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে সংবিধান সংশোধন করেছে। এই বাংলাদেশ সৃষ্টির যে চেতনা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা ছিলো তাকে ধবংস করে দিয়েছে, গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে দিয়েছে। তারা তাদের শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করবার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত যন্ত্রগুলোকে ব্যবহার করছে। এমন একটা প্রতিষ্ঠান নেই যে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে তারা বংশবদ করে ফেলেনি। এর মধ্যে যারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, রাজপথে নেমে এসেছিলেন তারা আজকে অনেকে আমাদের মাঝে নেই। তাদের অনেককে এনফোর্স ডিজএপিয়ারেন্স করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন আর খোঁজ নেই, গুম হয়ে গেছে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে অথবা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গোটা দেশকে গোটা জাতিকে একটা নির্যাতনের কারখানায় নিক্ষেপ করেছে সরকার।’
গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের ছোট ছোট সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তিনি আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন, ‘আজকে শিশুরা এখানে আছে। ওরা প্রতিমুহুর্তে ভাবে যে, তার বাবা ফিরে আসবে, আসে না। মায়েরা আছেন- ভাবেন যে, এই বোধহয় ছেলে দরজা নক করলো, আসে না। স্ত্রী অপেক্ষা করে থাকেন- কখন তার প্রিয় মানুষটা পাশে আসবে।’
ফখরুল বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে দেশে এখন একটা অসহনীয় একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ। এ সমাজ আজকে কিভাবে এই ধরনের
একটা পরিস্থিতি সহ্য করছে-এটাও একটা চিন্তার ব্যাপার। এরা সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নগুলোকে ছারখার করে দিয়েছে, তছনছ করে দিয়েছে। এজন্য তাদের দাম্ভিকতার শেষ নেই। তাদের কথা শুনবেন, তারা যে বক্তব্য রাখে, তারা যে কথা বলে, তার মধ্যে তাদের যে দাম্ভিকতা এটা প্রকাশ পায়। প্রতিমুহুর্তে এতো যে তারা নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে যাচ্ছে- এজন্য তাদের এতটুকু অনুতাপ পর্যন্ত কখনো হয় না। একনায়কদের, স্বৈরাচারদের কখনও অনুতাপ হয় না।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ‘সকলকে উঠে দাঁড়ানো’র আহবান জানান বিএনপি মহাসচিব।
সংগঠনটির সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা নাজিম উদ্দিন আলম, কামরুজ্জামান রতন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শফিউল বারী বাবু, মামুন হাসান, ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
Leave a Reply