হারিয়ে যাচ্ছে কিশোর কিশোরীদের পুতুল খেলা

গৌতম চন্দ্র বর্মন,ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : ‘চিরা কুটি কুটি/ আজ ফুতলির বিয়া/ ফুতলিরি নিয়া যাবে/ ঢাকে বাড়ি দিয়া/ ফেসী কান্দে ওসী কান্দে/ কান্দে মাইয়ার মা/ হোলা বিড়াল/ কাইন্দা মরে/ ঢোক মেলায় না।’ এমনই ছড়া কেটে কেটে শিশুদের পুতুল-আড্ডায় কয়েকজন হেসে ওঠে আর কয়েকজন পুতুলের সাথে কথা বলতে থাকে। এমন দৃশ্য এখন মা, বাবা, দাদা, দাদীদের প্রায় শুধু স্মৃতিচারণের বিষয়।

পুতুলের বর-কনে, সখা, সখিদের জায়গায় শিশুদের হাতে এখন স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশনের রিমোট। যেগুলো হয়ে উঠছে মাদকের মতো আসক্তিময়। শহরের অবস্থা আরও ভয়াবহ, শিশুরা সঙ্গী পাচ্ছে না, খেলার মাঠ পাচ্ছে না। সংকীর্ণ ঘরে মনও হয়ে উঠছে সংকীর্ণ হয়ে।

এমনও দেখা যায়, ফোন হাতে না দিলে ভাত খাবে না, উচ্চস্বরে কেঁদে উঠবে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলা যন্ত্রসমূহ শিশুদের করে তুলছে একে অপরের থেকেও বিচ্ছিন্ন। যেখানে পুতুল খেলার মতো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো শেখায় পারস্পারিক সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, মানবিক সম্পর্কের গভীরতা, সেখানে আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ কেড়ে নিচ্ছে মহৎ গুণাবলিসমূহ। হয়ে উঠছে ভিডিও গেমের যুদ্ধের মতো সংঘর্ষপ্রবণ। গড়ে উঠছে ভার্চুয়াল জগতের কৃত্তিম মানুষের মতো রোবটসদৃশ।

ইচিং বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ, পুতুল খেলা, কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, বউচি, জব্বারের বলীখেলা, টোপাভাতি, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, নুনতা খেলা, ফুল টোকা, বাঘ ছাগল খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, লাটিম, লুডু, ষোল গুটি, এক্কাদোক্কা, ঘুড়ি উড়ানো, পানিঝুপ্পা, গোলাপ-টগর, রুমাল চুরি ইত্যাদি নামসমূহ শিহরণ জাগানোর মতো খেলার নাম। এদের মধ্যে পুতুল খেলা একটি উল্লেখযোগ্য নাম।

এ খেলা গ্রাম বাংলার শিশুদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এটি সাধারনত মেয়েরা বেশি খেলে থাকে। বাংলার সর্বত্রই পুতুল খেলা সমান জনপ্রিয়। পুতুল খেলেনি এমন মেয়ে বাংলায় নেই বললেই চলে। বর্তমানে পুতুল শৌখিন মানুষের সংগ্রহেরও বস্তু।

গ্রামবাংলার বিভিন্ন মেলায় যেমন বৈশাখী মেলা, রথের মেলা, শিবরাত্রি, দশহারার মেলা, পৌষ সংত্রুান্তি ও নানা পাবর্ণে হরেক রকমের পুতুল পাওয়া যেত, এখন প্রায় শুধু প্লাস্টিকের পুতুলের চল হয়েছে।

অবুঝ আতিথেয়তার খেলায় মেতে উঠে গ্রামের সহজ সরল শিশুরা। কল্পনা থেকে বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার প্রতিভাই হচ্ছে পুতুলের বিয়ে খেলা। সাধারণত কোমল হাতের স্পর্শে দর্জির কাছ থেকে টুকরা কাপড় দিয়ে বা কলা গাছের ডোগোল দিয়ে তৈরি করে ছেলে-মেয়ে, বর-কনের মতো হরেক রকম পুতুল।

রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে ইত্যাদি নানা বিষয়ের অভিনয় করে খেলা হয় পুতুল খেলা। আসলে পুতুল খেলার মধ্যে পুরো সংসারের একটা প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।

পুতুলের মধ্য দিয়ে মিছেমিছি বিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকে গ্রামীন সরল শিশুরা। নিজেদের মতো করে পছন্দের খেলার সাথীর পুতুলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয় ঘটকের মাধ্যমে। প্রথা অনুযায়ী বর বা কনে পক্ষের বাড়িতে সওদা পাঠায় । অবুঝ শিশুদের মধ্যে আতিথেয়তার মান অভিমানও সৃষ্টি হয়।

পরম আত্মীয়তার সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে তারা। আর এ সম্পর্কের টানে জড় বস্তুর প্রেমে আকৃষ্ট হয় জীবজগৎ। জীবজগতে প্রত্যেক জীব বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক জালে আবদ্ধ। কেউ সাজে পুতুলের মা আবার কেউবা বাবা। মাসি-পিসি, ভাই-বোন, ননদি-দেবর, শ্বশুর-শ্বাশুরী সকলেই মমতাময়ীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় ।গর্ভধারীনী মা ও বাবার মতো কর্তব্য পালন করে পুতুলের বাবা-মা। পুতুলকে বিবাহ দেওয়া থেকে যাবতীয় কর্তব্য পালন করে ।

এই মিছেমিছি সম্পর্কের খেলায় গড়ে ওঠে গ্রাম-গ্রামান্তরের ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ গভীর সম্পর্ক। যা জাতি ধর্ম-বর্ণের গন্ডি ভেঙ্গে চুরমার করে। ফলশ্রুতিতে পৃথিবী হয়ে উঠে অতিথেয়তার চারণভূমিরূপে।

এখন এই শিশুরাই হয়ে উঠছে নিষ্ঠুর প্রতারক এক যন্ত্র, হারিয়ে ফেলছে মানবতা। এখন কারো কষ্টে তাদের মন গলে না। সামান্য পুতুল ভেঙ্গে গেলে তারা কেঁদে ফেলতো পুতুলের মায়ায়, তাই পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তার কবর কবিতায় লিখেছেন, ‘এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।’ যান্ত্রিক খেলনা শুধু শিশুর মনকে গ্রাস করে ফেলছে না, শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *