জামদানী শুধু ৬ গজ বস্ত্র নয়, কাপড় আর নকশার অসাধারণ বন্ধন
২৪ ঘণ্টা সংস্কৃতি। লেখিকা তানজিন তিপিয়া : জামদানী মূলত ৩ প্রকার- ১ সুতি জামদানী, ২ হাফসিল্ক জামদানী ও ৩ মসলিন জামদানী।
মুলত এই মসলিন জামদানী হতেই বাকি গুলোর উৎপত্তি মোঘল আমলে মসলিন খাটি সুতি কাপড়ে নকশা করাতেই জামদানী নামকরণ। আবিষ্কৃত হয় এক নিখুঁত হস্তের বিদ্যা।
বিস্তৃতি কমে যায় ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অধীনে, শিল্পজাত উৎপাদিত বস্ত্রের পক্ষে উপপনিবেশিক আমদানি নীতিগুলির কারণে বাঙালী জামদানী ও মসলিন শিল্পগুলো দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল।
ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে যন্ত্র নির্ভরশীলতায় এগোতে থাকাটাও, কম সময়ে অনেক উৎপাদন আর হাতের তৈরি এইকাজে খরচ হতো মাসের পর মাস। তাই তাঁতিরা অর্থনৈতিকভাবে বেশ বড় আঘাত পেয়ে জীবিকার দায়ে কাজ ছেড়ে অন্য পন্থায় লিপ্ত হয়ে বাঁচতে শুরু করেলেও বংশ পরম্পরা ধরে রাখতে তাঁতিরা তখনো হাল ছাড়েননি।
আরো খবর : জামদানী শাড়ির আদীকথা (১) ইতিহাস ও বংশপরম্পরার আভিজাত্যের প্রতীক!
তাঁদের হাল ধরা সেই সাহসিকতার কারণেই আজো বাংলায় জামদানী শব্দটির অস্তিত্ব বিরাজমান। জামদানী শুধুই ৬ গজ বস্ত্র নয়। কাপড় আর নকশার অসাধারণ বন্ধন যা নিজের মধ্যেই একটি সতন্ত্রতা বহন করে।
একটি ন্যূনতম কম কাজের জামদানী তৈরিতেও ২ জন কারিগরের লেগে যায় ৩-৭ দিন কাজের ধরণ ভেদে দিন এবং শ্রম বাড়তে থাকে। কোন কোন শাড়ির কাজ সম্পন্ন করতে লাগে ৬ মাস এমনকি ১ বছরও।
জামদানী শাড়ির বাকি ইতিহাস পড়তে চোখ রাখুন ২৪ ঘণ্টা ডট নিউজে। ৪ পর্বের আদিকথার তৃতীয় খণ্ডে থাকছে আরো চমকপ্রদ কিছু ইতিহাস।
ইদানিং নকশা নকল করে যন্ত্রে তৈরি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে আসল ঢাকাই জামদানী বলে। যা দুঃখজনকভাবেই কড়া সত্য, আমার খেটে খাওয়া তাঁতি ভাই বোনদের উপর বিরাট অন্যায়।
সাধারণত ৩টি প্রাথমিক নকশায় তৈরি হয় জামদানী। ১ বুটিদার, ২ তেড়ছি, ৩ জাল। তাছাড়া ঝোপা ফুল, মাছি ফোঁড়, এস্কা, জামিতি, চারকোণা, ফুলোয়ার, কলকা পাড়, দুরিয়া, দুবলি জাল, পান্না হাজার, ছিটা তেছড়ি হাঁটু ভাঙ্গা তেছড়ি, জুঁই বুটি, ছিটার জাল, সুঁই জাল, পুঁই লতা, আঙ্গুর লতা এমন হাজারো নকশা যার নামকরণ করে থাকেন তাঁতিরা নিজের মন মতো করে।
তাই জামদানী এই দেশীয় পোশাক শখ নয় আমার, অভ্যাসকারণ আমার মা, নানী সাহেবা খালা আর মামীদের কাছে এতো শুনেছি, এতোই পরিধান করতে দেখেছি আর যত্ন নিতে শিখেছি যে রক্ত আত্মায় মিশে গেছে এই কাপড়।
আম্মার ৫টা শাড়ি আছে যেগুলো বেশ পুরোনো। সবচেয়ে পুরোনো শাড়িটির বয়স ৪৩বছর, কালচে নীল শাড়িতে মাছিফোঁড়ের গাড় সোনালী মোটিফের কাজ, যা স্পর্শকরলেই অনুভব করা যায় কতোটা বৃদ্ধ হয়েছে এই শাড়ি আর পুরনো মাড়ের গন্ধ যা বাধ্য করবে চারদশক আগের পরিবেশকে কল্পনা করতে।
সেই সাথে শুনেছি আমার মায়ের দাদা রেঙ্গুন হতে ফিরে আসার গল্প। জাহাজ থেকে নেমে তিনি প্রথমে শহরের বাজার হতে উনার মা, একমাত্র মেয়ে সুলতান এবং স্ত্রী সাবেরার জন্য জামদানী শাড়ি কিনেই বাড়ির পথে রওনা দিতেন।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে যে সৌভাগ্য আমার হয়ে উঠেছে। আমিও দু’হাত মেলে শ্রদ্ধায় গ্রহণ করে অন্তর কোটরে প্রবেশ করিয়ে ফেলেছি। তাই রোজ জামদানী গাঁয়ে দেয়া আমার নিয়ম হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার কাছে যা স্বর্ণের চেয়ো বহুমূল্যবান।
এতে আছে আমার পূর্বনারীদের দোয়া,বাংলার ঐতিহ্যের প্রমাণ, আমার বাংলার তাঁতি ভাই বোনদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম।যতনে রাঙ্গানো সুতো, নিপুণতায় বোনা এক একটি ফুল। আমার বংশের তেজস্বিনী নারীদের গল্প, আমার বংশের আভিজাত্যের প্রতীক। স্বর্ণের চেয়ে মূল্যবান কেনই বা হবে না বলুন?
২৪ ঘণ্টা/লেখিকা-তানজিন তিপিয়া/ সম্পাদনা-রাজীব প্রিন্স
Leave a Reply