ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃমরিচের ঝালে মুখ জ্বলে এ কথা ঠিকই, কিন্তু এই ঝাল মরিচই ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। অল্প খরচে চাষ করে ভালো ফলন ও তুলনামূলকভাবে বেশি দাম পাওয়া যায় বলে মরিচ চাষ করে জেলার অনেক কৃষকই স্বাবলম্বী হয়েছেন ।
এমনকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও বাজারজাত হচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ের মরিচ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মরিচের চাষ তাই জেলার অনেক কৃষকের ভাগ্য ফিরিয়েছে।
গত বছরের তুলনায় এ মৌসুমে মরিচ চাষ ব্যাপকহারে বেড়েছে। বাজারে ভালো দাম ও চাহিদার বিবেচনায় চাষিরা এগিয়ে এসেছেন মরিচ চাষে।
আগে নিজের প্রয়োজনে বাড়ির আশপাশের কিছু জমিতে মরিচ চাষ থাকলেও এখন অনেক কৃষকই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মরিচ চাষ করছেন। অল্প জমিতে বেশি ফলন এবং অধিক মুনাফা পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে মরিচ উৎপাদনে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।
তীব্র তাপদাহ উপেক্ষা করে ক্ষেত থেকে তুলে কাঁচা-পাকা মরিচ পাশের রাস্তায়, রাইস মিলের চাতাল, আর বাড়ির উঠোনে শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা।
উঁচু যেসব জমিতে অন্য ফসল ভালো জন্মে না, সেসব জমিতে কৃষকেরা মরিচ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘা জমি থেকে ৯০-১০০ মণ কাঁচা মরিচ উৎপাদন হয়। আর কাঁচা মরিচকে শুকনা করলে বিঘা প্রতি পাওয়া যায় ১৫-২০ মণ। বিঘা প্রতি মরিচ উৎপাদনে খরচ হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। উৎপাদিত মরিচ বিক্রি করলে প্রায় ৯০ হাজার থেকে-১ লক্ষ টাকা পাওয়া যায়। কাঁচা বা শুকনো দু’ভাবেই মরিচ বিক্রি করা যায়। শুকনো মরিচ বিক্রিতে লাভ একটু বেশি হয়। অন্য যেকোনও ফসলের তুলনায় মরিচ চাষে লাভ বেশি, একারণে কৃষকরা মরিচে ঝুঁকেছেন বেশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ১১৭ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় স্থানীয় জাতের পাশাপাশি বাঁশগাইয়া, মল্লিকা, বিন্দু, হট মাস্টার, সুরক্ষাসহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের মরিচ আবাদ করা হয়েছে। জেলার উঁচু জমিতে অন্যান্য ফসল চাষাবাদে ফলন ভালো না হলেও মরিচ চাষে বাম্পার ফলন হয়। এমন জমিই মরিচ চাষে বেছে নিয়েছেন কৃষকরা। জেলার পাঁচ উপজেলাতেই কমবেশি মরিচ চাষাবাদ হয়ে থাকে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়ার রাজাগাঁও গ্রাম এলাকার কৃষক মো. শহিদুল্লাহ,পীরগন্জ উপজেলার পরেশ রায়,প্রদিব রায়, শরিফুল ইসলাম, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিশ্রামপুর গ্রামের লোলিত সিংহ সহ অনেকেই মরিচ চাষ করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন।
সদর উপজেলার নির্মল রায় জানান, এ বছর দুই বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। মরিচ বিক্রি করেছি ৫০ হাজার টাকার আরো শুকানো মরিচ আছে প্রায় এক লক্ষ টাকার।
সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামের মরিচ চাষি চাষী ননী গোপাল জানান, তিনি এবছর ২ একর জমিতে মরিচ আবাদ করেছেন। তার ক্ষেত থেকে প্রায় ৬০ মন মরিচ উৎপাদন হয়েছে। খরচ বাদ দিয়ে লাখ টাকার বেশি আয় হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
একই এলাকার কৃষক প্রকাশ বর্মন বলেন, ‘প্রতি মণ মরিচ ৫০০০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৫৫০০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।’
জেলার রুহিয়া থানার রাজাগাঁও গ্রামের কৃষক সুজন ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের চেয়ে মরিচ লাভজনক ফসল। আমি গত তিন বছর ধরে মরিচ চাষ করে আসছি। বলতে পারেন মরিচ চাষ করে আমি এখন স্বাবলম্বী।’
হরিপুর উপজেলার কৃষক সহরাব ইসলাম বলেন, ‘অল্প সময় ও অল্প খরচ এবং কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ার ফসল মরিচ। এ ফসল আবাদে আমাদের হয়রানি কম। যে কোনও স্থানেই মরিচ বিক্রি করা যায়।’মরিচ চাষে শুধু চাষিরাই নয়, শ্রমিকরাও লাভবান হচ্ছেন। মরিচ ক্ষেতে কাজ করে সংসারে বাড়তি আয় করতে পারছেন নারী শ্রমিকরা।
সদর উপজেলার চাপাতি এলাকার নারী শ্রমিক বৈশাখী বলেন, মরিচ চাষের কারণে আমাদের কাজের অভাব নেই। প্রতিদিন ক্ষেত থেকে মরিচ তুলি। প্রতি কেজি ৫ টাকা করে পাই। দৈনিক ২শ’ থেকে ২৫০ শ’ টাকা পাই। এ টাকা দিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলে যায়।
মরিচ কিনতে আসা ব্যবসায়ী রহিনি বর্মন বলেন,আমাদের ‘এ জেলার শুকনা মরিচ অনেক ভালো। প্রতি মণ শুকনা মরিচ ৫ হাজার থেকে-৫৫০০ টাকা মণ দরে ক্রয় করি। পরে এসব মরিচ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে থাকি। এতে আমার সংসার বেশ ভালোই চলে।’
মরিচের বাম্পার ফলন নিয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুরের মরিচ চাষী ননী গোপাল জানান, এবারে আবহাওয়া ভালো থাকায় ব্যাপকভাবে মরিচের ফলন হয়েছে। তাই আমরা সারাদিন মরিচ খেতে পাকা মরিচ তোলার কাজ করি।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১৪ নং রাজাগাঁও ইউনিয়নের চাপাতি গ্রামের জয়ন্ত জানান, আবহাওয়া ভালো থাকায় অনেক ভালো মরিচের ফলন হয়েছে। কম খরচে বেশি ফলন হয়েছে। অল্প খরচে বেশি লাভ হবে বলে আমরা আশা করি।এদিকে মরিচ চাষে শুধু চাষিরাই লাভবান নন, বেশি দাম পাওয়ায় লাভবান হয়েছেন কৃষক, দিনমজুর-সহ ব্যবসায়ীরাও। এসময় শ্রমিকরা একেকজনে প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজি মরিচ তুলে। মজুরি হিসাবে প্রতি কেজিতে পায় ৫ টাকা করে। যা থেকে তাদের দৈনিক আয় প্রায় ২০০-২৫০ টাকা। এবারে প্রতি বিঘা মরিচের চাষে খরচ হয়েছে ১৫-২০ হাজার টাকা। প্রতি মণ মরিচ ৫৫০০/৬২০০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে জানান চাষিরা।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আফতাব হোসেন জানান, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে কিছু কিছু এলাকায় ঘনঘন বৃষ্টি হওয়ার কারণে মরিচের গাছ মারা যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে খামারে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন উপসহকারী কৃষি অফিসারা।
২৪ ঘণ্টা/এম আর/গৌতম
Leave a Reply