নেজাম উদ্দিন রানা,রাউজান (চট্টগ্রাম): করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২১ মে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান চট্টগ্রামের রাউজানের ১০ নং পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের আধার মানিক গ্রামের এনায়েত ফকির বাড়ির মৃত নজির আহমেদের ১ম পুত্র মোহাম্মদ লোকমান (৪৮)।
করোনা পরিস্থিতিতে এমন দুঃসংবাদে পরিবারে নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। পরিবারের বড় সন্তানের মৃত্যু শোক তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি মৃত নজির আহমেদের পরিবার। এর মাঝে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদ। সমাজের আর দশটি পরিবারের মতো না হলেও শোকের আবহের মাঝেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে ঈদ উদযাপন করে পরিবারটি। কে জানতো মাত্র পাঁচদিনের ব্যবধানে প্রবাস থেকে আসা আরেকটি দুঃসংবাদ শোকে স্তব্ধ করে দেবে সবাইকে।
স্থানীয় লোকজন ও রাউজানের ১০ নং পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ দিদারুল আলমের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার মৃত নজির আহমেদের তিন পুত্রের মধ্যে সবাই প্রবাস জীবনে ছিলেন। পরিবারের বড় সন্তান মোহাম্মদ লোকমান (৪৮) ওমানে থাকতেন, মেঝ ছেলে মোহাম্মদ হারুণ (৪২) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে থাকতেন আর ছোট সন্তান মোহাম্মদ রফিক আবুধাবীতে কর্মরত ছিলেন।
তিন সন্তান প্রবাসে থাকায় মৃত নজির আহমেদের পরিবারে ফিরে এসেছিল আর্থিক সচ্ছলতা। সম্প্রতি সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে প্রবাস জীবনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত নজির আহমদের তিন পুত্রের মধ্যে লোকমান ও হারুণের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় দুজনের করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসলে ওমান ও দুবাইতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন দুই ভাই। রাউজানে লকডাউনের পরিস্থিতিতে দুই সন্তানের করোনা আক্রান্তের সংবাদে মুষড়ে পড়ে মৃত নজির আহমেদের পরিবার।
প্রতিদিন চাতক পাখির মতো এই পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষমান ছিলেন একটি সু সংবাদের। পুনঃ পরীক্ষায় রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে এই আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন করোনা আক্রান্ত লোকমান ও হারুণের পরিবার। এর মাঝেই গত ২১ মে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ওমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান পরিবারের বড় পুত্র মোহাম্মদ লোকমান। এমন বিয়োগান্তক ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পরে তার পরিবার। বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় লোকমানের লাশ পরিবারের সদস্যদের অনুমতিপত্র নিয়ে ওমানেই দাফন করা হয়। ফলে শেষবারের মতো তার মুখটাও দেখার সুযোগ হয়নি পরিবারের। একদিকে পরিবারের বড় সন্তানের মৃত্যু অপরদিকে দুবাইতে আরেক সন্তান মৃত্যুপথযাত্রী কঠিন এই পরিস্তিতির মাঝেও নীরবে শোককে পাথরচাপা দিয়ে ঈদ উদযাপন করতে থাকা পরিবারে প্রবাস থেকে আসা আরেকটি দুঃসংবাদে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে নজির আহমেদের পরিবার। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে পরিবারের মেঝ সন্তানটিও সবাইকে অশ্রুজলে ভাসিয়ে ২৫ মে ঘুম পাড়লেন চিরদিনের জন্য।
পর পর দুটি দুঃসংবাদ সাজানো একটি পরিবারের উপর যেন শক্তিশালী সাইক্লোনের মতো আছঁড়ে পড়ে তছনছ করে দিয়েছে পরিবারটির সাজানো স্বপ্নকে।
ঈদের দিনে এমন দুঃসংবাদ শুনে ঈদ আনন্দের মাঝে এনায়েত ফকির বাড়িতে নেমে আসে শোকের কালো ছায়া।
স্থানীয়রা জানান, লোকমানের মতো হারুণকেও প্রবাসের জমিনে দাফন করা হবে। কারণ বর্তমানে দেশে লাশ আনার সুযোগ নেই।
পরিবারের তিন প্রবাসী সন্তানের দুইজনের মৃত্যু শোকে যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মৃত নজির আহমেদের পরিবারের সদস্যরা।
লোকমান ও হারুণ বিবাহিত জীবনে দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। পিতার মৃত্যু সংবাদে দুই সহোদরের সন্তানদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।
শুধু এই পরিবারের সদস্যরা নয়, যারাই দুই ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেছে সকলেই চোখের জল সংবরণ করতে পারেনি। এলাকার মানুষের মুখে একটাই কথা, এই শোক পরিবারটি সইবে কেমনে?
পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই সহোদরের মৃত্যুর বিষয়টি সত্যতা নিশ্চিত করে রাউজানের ১০ নং পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, করোনা ভাইরাসে একই পরিবারের দুই সন্তানের মৃত্যুর বিষয়টি খুবই বিয়োগাত্মক ঘটনা।
১০ নং পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪ নং ওয়ার্ডে প্রবাসী লোকমানের মৃত্যুর বিষয়ে অবগত আছি। তার ছোট ভাই মারা যাওয়ার খবর এখনো পাইনি। ঘটনাটি হৃদয় বিদারক। আল্লাহ পরিবারটিকে এই শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি দান করুক।
২৪ ঘণ্টা/এম আর
Leave a Reply