২৪ ঘণ্টা ডট নিউজ। জেলার খবর : করোনা তুমি বুঝিয়ে দিলে নিষ্ঠুরতা কাকে বলে, করোনা তুমি দেখিয়ে দিলে কে আপন কে পর। এমনি এক নিষ্ঠুরতার শিকার চট্টগ্রামের একটি পেট্রলপাম্পের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত সাহাবউদ্দিন (৫৫)। স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও তিন জামাতা তার।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভাদাদিয়া গ্রামের হোসেন ডিলার বাড়ি তার পৈতৃক বসতঘর। সপ্তাহখানেক আগে গত ২৭ মে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে তার সেই ঘরেই ফেরেন।
তবে একটু স্বস্থির জন্য,শান্তির জন্যই ঘরে ফেরাটা লক্ষ্য হলেও জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাড়ি ফেরাটাই কাল হল সাহাবউদ্দিনের।
স্ত্রী সন্তানদের চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিয়ে ছটফট করতে করতে রবিবার রাতের কোনো এক সময়ে বন্দি ঘরেই প্রাণ হারিয়েছে সাহাবউদ্দিন। এমনকি মৃত্যুর পরও এগিয়ে এল না কোন স্বজন।
দুই ছেলে কাজের সূত্রে গ্রামের বাইরে থাকলেও মৃত্যুর সময় অন্যরা সবাই বাড়িতেই ছিলেন। তবে সাহাবউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাদের কাউকেই আর বাড়িতে পাওয়া যায়নি। আহ! কী নিষ্ঠুর পরিবার! নিষ্ঠুর স্ত্রী-সন্তান!
সারাজীবন যাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, সেই মানুষগুলোকে জীবন সায়াহ্নে পাশে তো পেলেনই না, এক চামচ পানিও না! অথচ তার করোনাভাইরাস কি-না সেটি তখনও নিশ্চিত না। স্ত্রী-সন্তানেরা এমন নিষ্ঠুরতা না করলেও পারতেন।
এমন না যে পরিবারের একজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলেই একে একে সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এমন না যে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শরীরে স্পর্শ লাগামাত্রই আপনি আক্রান্ত হয়ে যাবেন! সাহাবউদ্দিনকে ঘরে আটকে রেখেছেন ভালো কথা, বাইরে থেকে তাকে খাবার তো দেওয়া যেত।
স্বামী-স্ত্রীর সহমরণের কত নজির রয়েছে। বাবার জন্য সন্তান, সন্তানের জন্যে বাবা নিজেকে বলিদানের কত নজির। কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ দেখছি, যেখানে এতটা নিষ্ঠুর পরিবার স্ত্রী-সন্তানেরও দেখা মিলছে?
জানা যায়, গত ৩১ মে রোববার বিকালে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য সাহাবউদ্দিন নিজেই নমুনা দিয়ে আসেন। সেদিন রাতের কোন এক সময়ে মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভাদাদিয়া গ্রামের নিজ বসতঘরের দ্বিতল ভবনের একটি কক্ষে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর মরদেহ রেখে পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যান। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
স্থানীয়রা গণমাধ্যমকে বলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসা ছিল সাহাব উদ্দিনের ‘ক্ষমার অযোগ্য’ অপরাধ! এর শাস্তিস্বরূপ স্ত্রী-সন্তানেরা তাকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে সিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
ভেতরে আটকে পড়া সাহাব উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে দরজা খোলার অনেক আকুতি জানান। প্রচণ্ড ক্ষুধায় খাবার চান। তৃষ্ণা মেটাতে পানি চান। কিন্তু তার ভুলটা এত বেশি যে, কোনো আবেদনই মঞ্জুর হয়নি। রবিবার রাতের কোনো এক সময়ে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান সাহাব উদ্দিন।
সরেজমিনে দেখা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ইউপি সদস্য ফেরদৌস রাসেল বলেন, ‘বাড়ির একটি কক্ষে সাহাব উদ্দিনকে রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। ছিটকিনি খুলে আমরা ভেতরে বিভৎস দৃশ্য দেখতে পাই।
সম্ভবত সাহাব উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট উঠেছিল এবং তিনি তা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি করেছিলেন। তার পরনের কাপড় খোলা অবস্থায় পাশে পড়েছিল।’ পরে তারা দাফনের ব্যবস্থা করেন। পরিবারের কেউ আসেনি।
খবর পেয়ে মতিগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান রবিউজ্জামান বাবু ইসলামি আন্দোলনের করোনা রোগে দাফন টিমের লোকদের খবর দেন। দাফন টিমের সদস্যরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) ও থানা থেকে মরদেহ রাখার জন্য একটি ব্যাগ সংগ্রহ করেন। রাত ১টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে সুনসান নীরবতা দেখা যায়।
![দাফন টিমের লোকজন মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন](https://www.24ghonta.news/wp-content/uploads/2020/06/দাফন-টিমের-লোকজন-মৃত-ব্যক্তির-জানাজা-ও-দাফন-কার্যক্রম-সম্পন্ন-করেন.jpg)
গ্রামের মসজিদে রাখা লাশ বহনের খাট ব্যবহার না করার ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয়রা। কবর খোঁড়ার কোদালও দিচ্ছেন না কেউ। মরদেহ গোসল করানোর জন্য সমাজের পর্দাও না দেয়ার ঘোষণা দেন সমাজপতিরা। অবশেষে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ ব্যবস্থায় রাত ২টার দিকে দাফন টিমের লোকজন মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন।
মতিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউজ্জামান বাবু জানান, নিজের টাকায় কাফনের কাপড় কিনে, সমাজপতি, গ্রামের লোকদের অনেকটা বুঝিয়ে খাট ও পর্দার কাপড় সংগ্রহ করা হয়। রাত ২টার দিকে গ্রাম পুলিশ ও ইসলামি আন্দোলনের লোকদের সঙ্গে নিয়ে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মৃত ব্যক্তির মরদেহ দাফন করা হয়।
তিনি বলেন, করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত সাহাবউদ্দিনকে শেষ বিদায় জানাতে পরিবারের সদস্য, স্বজন ও বাড়ির লোকজন কেউ এগিয়ে আসেননি। সবাই পালিয়ে গেছেন। অথচ মৃত লোকটি পেট্রলপাম্পে কর্মরত থেকে চার ভাইকে প্রবাসে পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনটি মেয়ে বিয়ে দিয়ে জামাইদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজেও বহু অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। টাকাপয়সা রোজগার করে সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ তার এমন একটি মৃত্যু দিয়েছেন শেষ বিদায়ে কোনো স্বজন তার পাশে নেই। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে?
তিনি আরও বলেন, মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি কোনো শত্রুকেও যেন তিনি এমন মৃত্যু না দেন। এই মৃত্যু থেকে পৃথিবীর সব মানুষের শিক্ষা নেয়া উচিত। আসলে কার জন্য এই উপার্জন আর অর্থবিত্ত রেখে যাওয়া? করোনার এই মহামারীতে মানবতাও যেন আজ থমকে গেছে!
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. উৎফল দাস জানান, করোনা উপসর্গে মৃত ব্যক্তির কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
২৪ ঘণ্টা/রাজীব সেন প্রিন্স
Leave a Reply