করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও করভার কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়াতে বিলাস দ্রব্যসহ বেশকিছু পণ্যে শুল্ক ও করভার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও ওষুধ সামগ্রীতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতিসহ যেসব পণ্যে শুল্ক ও করভার কমানোর প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলোর দাম সঙ্গত কারণেই কমার কথা।
অন্যদিকে প্রসাধন সামগ্রী, মোবাইল ফোন সেবা, গাড়ির নিবন্ধন মাশুল, প্রক্রিয়াজাতকৃত মুরগীর মাংসসহ যেসব পণ্যে শুল্ক-কর ভার বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে সেগুলোর দাম বাড়তে পারে।
মহামারীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অর্থনীতির ক্ষত সারানোর পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট বৃস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩.২৪ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭.৯ শতাংশের সমান।
বিদায়ী অর্থবছরে মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৮ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৮.৩ শতাংশের সমান।
দাম বাড়তে পারে যেসবের
>> স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তথ্য-প্রযুক্তি খাতের লোডেড পিসিবি (প্রিন্টার সার্কিট বোর্ড), আনলোডেড পিসিবি এবং রাউটারের ওপর পাঁচ শতাংশ মূসক আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
>> আসবাবপত্রের বিপণন কেন্দ্রের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাতে ৭ শতাংশ করায় সেখানে বিক্রিত পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
>> শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চ সার্ভিসের মূসক দ্বিগুণ করে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বাড়তে পারে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চের ভাড়া।
>> কার ও এসইউভির নিবন্ধনসহ বিআরটিএর অন্যান্য মাশুলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকায় গাড়ি নিবন্ধনের খরচ বাড়বে। চার্টাড বিমান ও হেলিকপ্টার ভাড়ার ওপর সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ করার প্রস্তাব রাখায় এখাতেও ভাড়া বাড়তে পারে।
>> সব প্রসাধন সামগ্রীর ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
>> মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে।
>> সিরামিকের সিংক, বেসিন ইত্যাদি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করায় বেড়ে যাবে এসব পণ্যের দাম।
>> সিগারেটের চারটি স্তরের মধ্যে তিনটি স্তরের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, একটি স্তরের দাম অরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে বেশিরভাগ সিগারেটের দাম বাড়ছে। এছাড়া হাতে তৈরি ফিল্টারবিহীন ও ফিল্টারযুক্ত বিড়ির সব স্তরের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে বাড়ছে বিড়ির দাম।
>> পেয়াজের ওপর আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে নিত্য প্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে।
>> শিল্পের জন্য লবণ আমদানির ওপর শুল্কহার বৃদ্ধি করার প্রস্তাবে বাড়বে এই পণ্যের দাম।
>> প্রক্রিয়াজাত মুরগীর মাংসের অংশ বিশেষ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার বাড়ানোর প্রস্তাবে এ পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
>> আবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় যেমন- পেরেক, স্ক্রু ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্কহার বাড়ানোর প্রস্তাবে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
>> তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুৎসাহিত করতে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে যে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হত তা প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বাড়বে ফার্নেস অয়েলের দাম।
দাম কমতে পারে যেসবের
>> করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২-এর কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্থানীয় উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির ওপর আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে সাধারণভাবে স্থানীয়ভাবে তৈরি সব পণ্যের দাম কিছুটা কমার কথা।
>> কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা কিটের আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে মূসক অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পিপিই এবং ফেইস মাস্কসহ সার্জিক্যাল মাস্কের উৎপাদন ও ব্যবসা পযায়ে মূসক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ নিরোধক ওষুধ আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসা পযায়ে মূসক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে কমছে এসব পণ্যের দাম।
>> দেশের টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশের জন্য পলিস্টার, রেয়ন ও অন্যান্য সব সিনথেটিক সুতার ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রতি কেজিতে সুর্নিদিষ্ট ৬ টাকা করা হয়েছে এবং সব ধরণের কটন সুতার ওপর কর প্রতি কেজিতে ৪ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ টাকা করা হয়েছে।
>> এসএমই শিল্পের পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়ায় সেসব পণ্যের দাম কমবে।
>> মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের জন্য সয়াবিন অয়েল কেক ও সয়া প্রোটিন কনসেনট্রেট আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়ায় এ দুটি পণ্যের দাম কমতে পারে।
>> দেশের আলু দিয়ে পটেটো ফ্ল্যাকস তৈরির ওপর ১৫ শতাংশ মূসক কমিয়ে ৫ শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করায় পণ্যটির দাম কমতে পারে।
>> একইভাবে স্থানীয়ভাবে ভুট্টার গুঁড়ো (মেইজ স্টার্চ) তৈরির ওপর ১৫ শতাংশ মূসক কমিয়ে ৫ শতাংশে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এটির দাম কমতে পারে।
>> স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষার তেলের ওপর মূসক অব্যাহতি দেওয়ায় এর দাম কমতে পারে।
>> কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রোটারি টিলালের মত পণ্যে ব্যবসায়িক পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি দেওয়ায় এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। কৃষিতে ব্যবহৃত দুই ধরনের স্প্রে করার যন্ত্রের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাবে দাম কমবে এই পণ্যেরও।
>> সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধার্থে সোলার মেশিনের জন্য ৬০ এএমপি পর্যন্ত ব্যাটারি কেনার ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
>> স্বর্ণ আমদানির ওপর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে কমতে পারে সোনার দাম।
>> দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় রেফ্রিজারেট ও এয়ারকন্ডিশনারের কম্প্রেসার উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে দেশে তৈরি এ দুটি পণ্যের দাম কমতে পারে।
>> ডিটারজেন্ট শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল এলএবিএসএ-এর শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করায় এর দাম কমতে পারে।
>> ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
>> প্ল্যাস্টিক ও প্যাকেজিং শিল্পের ফটোগ্রাফিক প্লেটস আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
>> কাগজ উৎপাদন শিল্পের কাঁচামাল ওয়াশিং অ্যান্ড ক্লিনিং এজেন্ট আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে কমতে পারে দেশীয় কাগজের দাম।
> গভীর সমুদ্রে জেলেদের মাছ ধরার অন্যতম প্রধান উপকরণ ইলেকট্রিক্যাল সিগনালিং ইক্যুইপমেন্ট আমদানিতে শুল্কহার কমানো হয়েছে। ফলে দাম কমবে এই পণ্যের।
২৪ ঘণ্টা/এম আর
Leave a Reply