বাজেট ‘অন্তঃসারশূন্য-কল্পনাপ্রসূত’ বললেন ফখরুল

করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই উল্লেখ করে একে ‘অন্তঃসারশূন্য-কল্পনাপ্রসূত’ বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুক্রবার বিকালে উত্তরার বাসা থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাছে তিনি একথা বলেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, করোনা কাটিয়ে একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাজেটে নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্ধ করা হয়নি।আমরা ভেবেছিলাম, জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে এই বাজেটটা প্রণয়ন হবে, সেটা তো হয়নি।

তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে এই বাজেট প্রকৃত অর্থে একটি অন্তঃসারশূন্য কল্পনাপ্রসূত কথার ফুলঝুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বাজেট জনবান্ধব হয়নি।

তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী গতকাল একটা অবাস্তবায়নযোগ বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটা জাতিকে হতাশ করেছে।এই মুহুর্তে যেটা প্রয়োজন জাতির জন্যে, মানুষের জন্যে, মানুষগুলো বেঁচে থাকার জন্যে, উত্তরণ ঘটানোর জন্যে-কোনটাই এই বাজেটে আসেনি। এখানে যেটা এসেছে আমরা বলেছি তাদের যে চিন্তাটা কমিশন পাওয়া এটা এখানে (বাজেট) এসেছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি না করে ‘বর্তমান ব্যয়’ বহাল রাখার আহবান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।

বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণকে ‘অসম্ভব’ এবং আয়-ব্যয়ের গ্রহনযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, সরকার বলছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে এবং ২০২০-২১ সালে হবে মাত্র ১ শতাংশ। সেখানে অর্থমন্ত্রী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন।

তিনি বলেন,আমদানি, রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মাইক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটরগুলো আলোচনা করলেই স্পষ্ট যে, ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। এটা করতে গেলে বিনিয়োগ দরকার ৩২-৩৪ শতাংশ যা কঠিন ও অসম্ভব।”

জিডিপি ও রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা ‘প্রতারণার শামিল বলে মন্তব্য করেন ফখরুল। বাজেটে কালো টাকা সাদা করতে সুযোগ দেয়ার সমালোচনা করে অর্থনীতির সাবেক এই শিক্ষক বলেন, গত এক দশককালের অধিকাল ব্যাপী সরকার দলীয় যে সকল ব্যক্তি নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে তাদের টাকা সাদা করার জন্য সরকার এবার কালো টাকা সাদা করার স্কোপ বৃদ্ধি করেছে। আমরা এহেন অনৈতিক, দুর্নীতি সহায়ক, বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক পদক্ষেপ গ্রহন করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা বিদেশে পাঁচার হয়ে যাওয়া লক্ষাধিক কোটি টাকার যে খতিয়ান দেশি-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তা দেশে ফিরিয়ে আনার কার্য্কর উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় বরাদ্ধ কম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে এটা একেবারেই ঠিক হয়নি, এই খাতে আরো অনেক বেশি বরাদ্ধ দেয়া উচিত ছিলো। এটা শুধু আমরা বলছি না, যারা বিশেষজ্ঞ চিকিতসক আছেন তারাও এই কথাটা বলছেন। আপনি দেখুন সারাদেশে আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স নাই, জেলাগুলোতে কোনো আইসিইউ খুঁজে পাবেন না। ঢাকা শহরের মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলো আছে যেগুলো আপনার কোবিড-১৯ চিকিতসার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানেও কিন্তু পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। মানুষ অক্সিজেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য হাহাকার করছে।

তিনি আরও বলেন, আপনি স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা দেখছেন- কিভাবে এই খাত ভেঙে পড়েছে, ভঙ্গুর হয়ে গেছে। মানুষ কোথাও কোনো রকম চিকিতসা পাচ্ছে না। দেখুন বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর ওপরে সব ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যাচ্ছে ঠেলা গাড়িতে করে রোগী নিয়ে যায়, ভর্তি হতে পারে না, সেখান থেকে মৃতদেহ নিয়ে বাসায় আসছে। এই যে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, তাদের অহংকার, তাদের দাম্ভিকতা এবং তারা নিজেরাই সব কিছু করতে পারবে এই যে একটা ধারণা, এই ধারনাই বাংলাদেশকে এ্ই অবস্থায় ফেলেছে।

সরকারের রাজস্বের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে ফখরুল বলেন, রিভিউ আর্নিং- টাকাটা আসবে কোত্থেকে? সরকার যেভাবে বলছে যে, সে টাকা তো আসবে না। ৫০% এর অধিক রেভিনিউ হতে হবে যে বাজেট দেয়া হয়েছে। ওইটা বলে তো লাভ নেই, এটা অবাস্তব হবে। আর টাকা কোত্থেকে আনবেন? সেজন্য আমরা বলছি যে, মেগা প্রজেক্টগুলোতে শুধু দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলোতে বরাদ্ধ কমিয়ে দিয়ে অথবা বিলম্ব করে অনায়াসে নিতে পারতেন জরুরী খাতগুলোতে।রূপপুর আনবিক প্রকল্প, এটাতে কী বরাদ্ধ দেয়া এসেনশিয়াল হয়ে পেড়েছে? এমনিতেই বিদ্যুত উদ্ধৃত্ত হয়ে আছে বলে আপনারা(সরকার) বলছেন। তাহলে রুপপুর আনবিক প্রকল্পে এখন বরাদ্ধের দরকার কী?….।

তিনি বলেন, আমরা যেসব কথা এখন বলছি এটা শুধু আমাদের কথা নয়, যারা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আছেন এবং যারা বিভিন্ন সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারা সবাই কিন্তু এক বাক্যে এই কথাটা বলছেন যে- এই বাজেটটা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য একেবারেই উপযোগী নয়।

তিনি বলেন, আসলে এখন আপদকালীন বাজেট করা উচিত ছিলো। সামনে তো ভয়ংকর অবস্থা আসবে। মাইক্রো ইকোনমিক্সের অবস্থা কি হবে সেটা যারা ভুক্তভোগী তারাই বলতে পারবেন অর্থাত সমগ্র দেশের মানুষ সেটা বলতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার এটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা সেই চিরায়ত গতানুগতিক লক্ষ্য তো একটা- কি করে সেখান থেকে কিছু টাকা পয়সা বানানো যায়-সরি টু সে দেট। দেট হেজ বিন ডান ইন দিস কান্ট্রি।এটাই করা হচ্ছে।

শিক্ষাখাত, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির স্বার্থরক্ষা, বেকারত্ম দুরীকরণ, কৃষিখাত, কুটির শিল্পখাত, পল্লী উন্নয়নখাতে বাজেটে যে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে তা ‘অপ্রতুল’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব। পানি সম্পদ ও দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্ধ হ্রাস, করোনা পরিস্থিতিতে প্রবাসী ও পোষাক শিল্পখাতের বিষয়ে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা থাকার সমালোচনাও করেন বিএনপি মহাসচিব।

বাজেটে ব্যাংকি খাতসহ অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাবও নেই উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, বরং শীর্ষ ঋণ পরিশোধে আরো সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যা ব্যাংকিং খাতকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দেবে, আর্থিক শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়বে।

বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট (এডিপি) বরাদ্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নয়ন খাতে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। করোনা সংকট মোকাবিলায় মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এই উন্নয়ন খাত থেকে এক লাখ কোটি টাকা করোনা সংকট মোকাবিলায় দেয়া তো। কারণ উন্নয়ন খাতে শুধু লুটপাট হয়।

করোনা মহামারীর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার কঠিন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মত।

২৪ ঘণ্টা/এম আর

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *