করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ঈদুল আযহার কিছু উৎসবকে এবার কোরবানী দেওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন।
তিনি আজ রবিবার (১২ জুলাই) বিকাল ৩টায় উত্তর কাট্টলীস্থ নিজ বাসভবনে তার ফেসবুক পেইজে লাইভে আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে কোরবানী বিষয়ে নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা নগরবাসী এবং সাংবাদিকবৃন্দের উদ্দেশ্যে পেশ করেন।
এ সময় সুজন বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে মুসলিম সমাজের অন্যতম ওয়াজিব ইবাদত ঈদুল আযহা। এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবার ঈদুল ফিতরের উৎসব বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজ অত্যন্ত সীমিত আকারে উদযাপন করেছে। এমনকি ইসলামের অন্যতম ফরজ হজ্ব পালন থেকে নিবন্ধিত হাজীরা বিরত রয়েছেন। ঈদুল আযহার দুইটি অংশ। একটি ১০ই জিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর নির্ধারিত স্থানে নামাজের জন্য সমবেত হওয়া, ঈদুল আযহার খুতবা শোনা ও দুই রাকাত নামাজ আদায় করা। আর অন্যটি হচ্ছে পশু কোরবানী দেওয়া। কোরবানী হচ্ছে একটি শর্তসাপেক্ষ ওয়াজিব। শুধুমাত্র যে সকল সাবালক মুসলিম যিনি সংবৎসর প্রয়োজনীয় খরচ নির্বাহ করার পর কোরবানীর পশু কেনার সামর্থ আছে তাহার উপরই এই ওয়াজিব প্রযোজ্য।
সুতরাং মরনঘাতি বৈশ্বিক মহামারীর সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে যেখানে হজ্বের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আদায় করা যাচ্ছে না সেখানে কোরবানীর মতো একটি শর্তসাপেক্ষ ওয়াজিব পালনে আমাদের সংযমী হতেই হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে পবিত্র ঈদুল আযহার কিছু উৎসবকে আমাদের এবার কোরবানী দিতে হবে। যতটুকু প্রযোজ্য ঠিক ততটুকু পালন করে অন্যবারের মতো বাড়তি উৎসব উদযাপন থেকে বিরত থাকতে দেশের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইদের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিগত চারমাস গণছুটি এবং লকডাউনের কারণে বিভিন্ন কলকারখানা, বেসরকারী, স্বায়ত্বশাসিত, আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ অবস্থায় আছে। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেনে বৈশ্বিক মন্দাভাব এখানেও বিরাজমান। এই পরিস্থিতি আরো কয়মাস চলে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তাই সকলকে প্রাত্যহিক জীবন যাপনের ব্যয় নির্বাহে অত্যন্ত মিতব্যয়ী হতে হবে। এবারের কোরবানীর ঈদেও মিতব্যয়িতার সাথে পালন করতে হবে। কোরবানী নিয়ে সামাজিক চাকচিক্য ও বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা কোনভাবেই করা যাবে না। কোরবানী পালন ওয়াজিব, আর জীবন রক্ষা ফরজ। সুতরাং জীবন রক্ষাকে আগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
ঈদুল আযহা উদযাপন ও পশুর হাট পরিচালনার জন্য নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ ও প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পশু বেচাকেনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ এবং জনসাধারণের জন্য তুলে ধরেন তিনি।
১। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ঠেকাতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কারিগরি কমিটি। নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে আমরা সর্বান্তকরণে এ সুপারিশকে স্বাগত জানাই। যেহেতু ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে পশু পালন করেছেন খামার মালিক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তারা। আর কোরবানীকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় সারাদেশে। চামড়া খাতেও কোরবানীতে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। এছাড়া দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে কোরবানীর চামড়া। তাই বিশাল এ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনে পশু বেচাকেনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং এ ধরণের বেচাকেনায় ভ্যাট, হাসিলসহ সকল প্রকার কর ও টোল আদায় রহিত রাখতে হবে।
২। শহরের মধ্যে কোন বড় পশুর হাট থাকবে না। থানা ভিত্তিক আঞ্চলিক পশুর হাট হতে হবে। কেননা কেন্দ্রীভূত পশুর হাট কমিউিনিটি সংক্রমণের প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই ক্রেতা সাধারণের প্রতি অনুরোধ থাকবে পশু ক্রয় করার জন্য সারা শহর না ঘুরে নিকটস্থ স্থানীয় পশু হাট থেকেই যেনো পশু ক্রয় করে। ঠিক তেমনি বিক্রেতাদের নিকটও অনুরোধ থাকবে ক্রেতার উপর যেনো পশুর অতিরিক্ত দাম না হাঁকে। পশু ক্রয়ের উপর ৫% হারে লভ্যাংশ যোগ করে পশু বিক্রয় করে। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কাছে আবেদন থাকবে পশুর হাটে গিয়ে যেনো পশুর দাম তদারকি করে। আর অনলাইন বিক্রেতারা যে হাটে গরু বিক্রয়ের জন্য নিবন্ধন করবে সে বিক্রেতা অন্য হাটে গরু বিক্রয়ের জন্য নিবন্ধিত হতে পরবে না। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পোস্তার পাড় স্থায়ী ছাগল বাজারটিও পলোগ্রাউন্ড মাঠে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩। যদি পশু বিক্রয় কার্যক্রমকে পুরোপুরি অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসা না যায় সেক্ষেত্রে অস্থায়ী পশুর হাট ইজারাদারকে সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী যেমন মাস্ক, সাবান এবং জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪। মাস্ক ছাড়া কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা হাটে প্রবেশ করতে পারবে না। পশুর হাটে আগত ক্রেতাদের পরিষ্কার পানি সরবরাহ ও হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সাবানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫। সর্দি, কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ হাটে প্রবেশ করতে পারবে না। শিশু, বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ কেউ হাটে আসতে পারবে না।
৬। পশুর হাটের সঙ্গে যুক্ত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও হাট কমিটির সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। হাট কমিটির সবার ব্যক্তিগত সুরক্ষা জোরদার নিশ্চিত করতে হবে।
৭। চলমান পরিস্থিতির কারণে একটি পশু কিনতে ১ জন কিংবা সর্বোচ্চ ২ জনের বেশী কেউ হাটে প্রবেশ করতে পারবে না ।
৮। পশুর হাটের সাথে যুক্ত সব স্বেচ্ছাসেবকদের স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিতে হবে। যেমনঃ মাস্কের সঠিক ব্যবহার, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, জীবাণুমুক্তকরণ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো সার্বক্ষণিক মাইকে প্রচার করতে হবে এবং সকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি-না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
৯। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পশু হাট চালু থাকবে। কোন অবস্থাতেই একবারে ২৫০ জনের অতিরিক্ত ক্রেতা হাটে প্রবেশ করতে পারবে না। সর্বোচ্চ এক ঘন্টার মধ্যে ক্রেতাকে তাঁর চাহিদা মতো পশু ক্রয় করে হাট থেকে অবশ্যই বের হয়ে যেতে হবে।
১০। পশুর হাটে আলাদা আলাদা প্রবেশপথ ও বাহিরপথ নির্দিষ্ট করতে হবে। কোন অবস্থাতেই একই পথ দিয়ে প্রবেশ এবং বাহির হতে পারবে না।
১১। হাটের ভিতর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একটি পশু থেকে আরেকটি পশু এমনভাবে রাখতে হবে যাতে ক্রেতারা কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে পশু কিনতে পারেন।
১২। পর্যাপ্ত পানি ও ব্লিচিং পাঊডার দিয়ে পশুর বর্জ্য দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে। কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি করা যাবে না। নিরাপদ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১৩। হাটে ভিড় এড়াতে মূল্য পরিশোধ ও হাসিল আদায় কাউন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। হাটে পর্যাপ্ত সংখ্যক নগদ, বিকাশ, রকেট এবং ব্যাংক ক্যাশ কাউন্টারসহ টাকা লেনদেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১৪। প্রতিটি পশুর হাটে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর মাধ্যমে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে হবে। যাতে ক্রেতা বিক্রেতাসহ সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে এবং আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকে।
১৫। কোরবানী পশু হাটের আশে পাশে কোন প্রকার হোটেল, রেস্তোরা কিংবা খাবারের দোকান থাকতে পারবে না। ক্রেতাগণ নিজ নিজ বাসা থেকে শুধুমাত্র পানির বোতল নিয়ে আসতে পারবেন।
১৬। ঈদুল আযহার ছুটিকে সংশোধিত করে উৎসবের আগের দিন ২টা থেকে শুরু করে ঈদের দিন এবং ঈদের পরদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত রাখতে হবে।
১৭। ঈদের ২ দিন আগে এবং ২ দিন পর পর্যন্ত এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াতকারী সকল প্রকার গাড়ী চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। জেলার অভ্যন্তরে সীমিত আকারে হালকা যানবাহন ও প্রাইভেট গাড়ী চলবে। গণপরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে।
১৮। ঈদের ছুটিকালীন সময়ে সকল ফেরীঘাট বন্ধ থাকবে। যে সকল ফেরী ঘাটে স্পীডবোট চলাচল করে সেগুলোও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হবে। দুইটি ফেরী চালু থাকবে শুধুমাত্র পশু, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ও জ্বালানী তেলবাহী ভাউচার পরিবহনের জন্য।
১৯। কোরবানীর গোশত কাটার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কোরবানীর তিনদিন পূর্বেই নন কোভিড সনদ গ্রহণ করতে হবে। নন কোভিড সনদ ছাড়া কেউ কোরবানীর গোশত কাটার সাথে জড়িত হতে পারবে না।
২০। কোরবানী হবে একদিন। একদিনেই সকল প্রকার বর্জ্য অপসারণ করতে হবে। কোরবানীর পরদিন যেনো কেউ কোরবানী দিতে না পারে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা নগরবাসীকে অনুরোধ জানাবো যে যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই যেনো ঈদ উদ্যাপন করে। কারো পরিবার বাড়িতে অবস্থান করলে সেক্ষেত্রে কোরবানীর আগেই প্রয়োজনীয় টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশে সংক্রমণ এখন কিছুটা কমতির দিকে। সে হার অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা কোনভাবেই আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারি না। আমরা যদি কিছুটা উৎসব কোরবানী দিতে পারি তাহলে সুস্থ অবস্থায় আগামী বছরগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করতে পারবো। পশুর হাট যাতে কোন অবস্থাতেই করোনা সংক্রমণের হট স্পট হতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সবার প্রতি তিনি বিনীত অনুরোধ জানান। সকলের প্রচেষ্টায় এ দেশকে আমরা ক্রমশ সুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারবো বলে দৃঢ় বিশ্বাস জ্ঞাপন করেন তিনি।
২৪ ঘণ্টা/এম আর
Leave a Reply