শাহজাহান আলী মনন, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি ॥ ‘স্যার আমার টাকাটার খুব দরকার, সরকার দয়া করে আমাকে যে বয়স্ক ভাতা দেয়, সেই টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে কোন রকমে বেঁচে আছি। তাই একবারে সব টাকা কেটে নিলে আমি ওষুধ কিনবো কি দিয়ে? আর ওষুধ না খেলে বাঁচবো কেমন করে? এর চেয়ে আমাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেন। তাও টাকা পেয়েও ওষুধ কিনতে না পারার কষ্ট দিয়ে মারেন না।’
এমন করেই করজোড়ে আকুতি করছিল এক বৃদ্ধ। কিন্তু তারপরও বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলেন না ব্যাংক ম্যানেজার। বরং তিনি ১ হাজার টাকার ঋণ কর্তনের রিসিভ কেটে বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক প্রকার তাড়িয়ে দিলেন। ‘যান যান এখান থেকে বিরক্ত করবেন না, আমার অনেক কাজ আছে। আপনাদের আমি ভাল করেই চিনি। এভাবে টাকাটা কেটে না নিলে জীবনেও দিবেন না। ভাতা পাওয়ার আগে যেভাবে ওষুধ ছাড়াই বেঁচে ছিলেন সেভাবেই এখনও চলবেন। তা না হলে ঋণ শোধ না করেই কবরে যেতে হবে। তখন পরকালেও দূর্ভোগ পোহাতে হবে।’
উপরোক্ত দৃশ্যটি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের হাজারীহাট রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক শাখার। গত ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের সামনেই একজন বৃদ্ধ গ্রাহকের সাথে এমন আচরণ করেন শাখা ব্যবস্থাপক মোঃ রাশেদুজ্জামান সরকার। তার এমন রূঢ় আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গেল বৃদ্ধ।
এসময় উপস্থিত সংবাদকর্মীরা বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আমার নাম বদর উদ্দিন। আমার ছেলে ১৯৯১ সালে ১ হাজার ৮ শ’ টাকা কৃষি ঋণ নিয়েছিল। যা পরবর্তীতে মাপ করে দেওয়া হয়েছিল বলে আমি জানি। আমার বয়স ১১০ বছর। এলাকার মেম্বারের সহযোগিতায় গত ১ বছর যাবত সরকার দয়া করে আমাকে বয়স্কভাতা দিচ্ছেন। প্রতি ৩ মাস পর পর ১ হাজার ৫শ’ করে টাকা এই শাখা থেকে পাই।
এই বৃদ্ধ বয়সে নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছি। বিশেষ করে শ্বাষকষ্টে চরম ভোগান্তিতে আছি। বয়স্কভাতার টাকাটা দিয়ে ওষুধ কিনে কোন রকমে বেঁচে আছি। ছেলেরা দেখেও দেখেনা। তাই অনেক কষ্টে মানুষের কাছে চেয়ে চিমটে পেট চালাই। সরকার এই ভাতাটা দেওয়ায় অনেকটা স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে গত আগস্ট মাসে ভাতা তুলতে আসলে ম্যানেজার মাত্র ৫শ’ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, আমার নামে ঋণ আছে তাই ১ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। আমিতো হতভম্ব! অনেক অনুরোধ করেও তার মন গলাতে পারিনি। বাধ্য হয়ে গত ৩ মাস ওষুধ কিনতে না পারায় অনেক কষ্ট করে কাটিয়েছি।
তাই এবার বললাম যে, ঋনের টাকাটা প্রতিবারে ৫শ’ টাকা করে কেটে নিতে। তাহলে ঋণও পরিশোধ হবে আমারও ওষুধ কিনতে না পেরে কষ্ট হবেনা।
কিন্তু না, তিনি কোন কথাই শুনতে রাজি নন। এবারও ১ হাজার টাকাই কেটে নিলেন। ম্যানেজারের বক্তব্য আমি যদি মরে যাই তাহলে বয়স্ক ভাতাও পাবনা এবং ঋণও পরিশোধ হবেনা। তাই বেঁচে থাকতেই টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। এখন আমি ওষুধ ছাড়া কিভাবে চলবো? ঋণ পরিশোধের আগেই তো ওষুধ না পেয়ে মরে যাবো! তখন তার ঋণ পরিশোধ করবে কে?
এমন দুঃখভরা আবেগ নিয়ে প্রশ্নগুলো করে হাতের লাঠিতে ভর করে বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সংবাদকর্মীরা বৃদ্ধের জন্য কিছু করা যায় কি না ভেবে শাখা ব্যবস্থাপককে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, কোন উপায় নেই।
টাকাটা আমাকে নিতেই হবে। তার ঋণ ছিল ১ হাজার ৮শ’ টাকা যা সুদ ও আসল মিলে হয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ টাকা। দীর্ঘদিন থেকে তিনি ঋণ পরিশোধ করছেন না।
এতদিন কেন তাকে ধরেন নাই বা অল্প অল্প করে কেটে নিলেও তো পারেন এমন প্রশ্নের জবাবে শাখা ব্যবস্থাপক সংবাদকর্মীদের কটাক্ষ্য করে বলেন, কখন ধরবো আর কখন ধরবোনা তা কি আপনাদের কাছ থেকে শিখতে হবে। আমার ব্যাংকের পলিসি অনুযায়ী আমি কাজ করেছি। আপনাদের তার প্রতি বেশি দয়া হলে নিজেরাই তার ঋণ পরিশোধ করে দেন বা তাকে ওষুধ কেনার টাকা দেন।
এভাবে গ্রাহককে টাকা বুঝিয়ে না দিয়েই ঋণ পরিশোধের নামে কর্তন করার কোন বিধান কি আপনাদের আছে? এমন প্রশ্ন করা হলে শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, সব নিয়মই কি লিখিত আকারে থাকে। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ব্যাংকের স্বার্থে যা করা দরকার তাই করি। এতে কেউ কোন অভিযোগ করেও কোন লাভ নেই। বর্তমান ইউএনও’র কাছে অনেকেই আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন তাতে আমার কিছুই হয়নি। আপনাদের ইচ্ছে হলেও করতে পারেন।
এসময় দেখা যায়, শাখা ব্যবস্থাপকের টেবিলে অনেক ভাতাগ্রহিতার পাশবই রক্ষিত। তিনি আরও অনেক ভাতাগ্রহিতা টাকা নিতে আসলে তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে ৩শ’ থেকে সর্বোচ্চ ৫শ’ টাকা কেটে নিচ্ছিলেন ঋণ পরিশোধ বাবদ। অথচ বদর উদ্দীনের অনুরোধ কেন রাখলেন না। এমন অমানবিক না হলেও তো পারতেন। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রচন্ড রেগে যান এবং বলেন, আমি কি করবো আর কি না করবো সে বিষয়ে আপনারা বলার কে? এটা আমার অফিস, আমি আমার মত করেই কাজ করবো। কোন অনিয়ম হলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসকে কোন জবাবদিহি করতে হলে তখন দেখা যাবে। আপনারা এখন যান।
এ ব্যাপারে তাৎক্ষনিক মুঠোফোনে সৈয়দপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মোছাঃ হাওয়া খাতুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বয়স্কভাতাসহ সরকার প্রদত্ব যে কোন ভাতা গ্রহিতাদের হাতে তাদের প্রাপ্য টাকা দিতে বাধ্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর পর যদি তাদের কোন দেনা-পাওনা থাকে তা গ্রাহকের অনুমতি সাপেক্ষে পরামর্শক্রমে নিতে পারে। কিন্তু তাতে যেন যে উদ্দেশ্যে সুবিধাভোগীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে তা ব্যাহত না হয় বা গ্রাহক ভোগান্তির শিকার না হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম গোলাম কিবরিয়াকে জানানো হলে তিনি বলেন, ব্যাংক ম্যানেজার এমনটা করতে পারেন না। তিনি যদি এধরণের আচরণ করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, এই শাখা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে স্থানীয় গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে হয়রানী করাসহ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন উপস্থিত অনেক ভাতাভোগীসহ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
Leave a Reply