গ্যাসের দাম বাড়ল ২২.৭৮%, দুই চুলায় দিতে হবে ১০৮০ টাকা

দ্রব্যমূল্য নিয়ে পেরেশানিতে থাকা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংসার খরচ আরও বাড়িয়ে এবার বাড়ল গ্যাসের দাম।

পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা চলতি জুন মাস থেকেই কার্যকর হবে।

খুচরা পর্যায়ে সেই মূল্য সমন্বয় করে যানবাহনে ব্যবহারের সিএনজি বাদে সব পর্যায়েই গ্যাসের জন্য খরচ বাড়বে।

রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বেড়ে হচ্ছে ১০৮০ টাকা। এক চুলার মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা করা হয়েছে।

আর আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ টাকা। সার্ভার সিস্টেম আপডেটে করার মাধ্যমে এ মাসেই নতুন দাম কার্যকর হয়ে যাবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ০২ পয়সা করা হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬ টাকা। আর সার কারখানার জন্য ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে।

শিল্প কারখানায় আগে গ্যাসের মূল্য ছিল প্রতি ঘনমিটার ১০ টাকা ৭০ পয়সা। এখন বৃহৎ শিল্পকে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পকে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা করে দিতে হবে।

বাণিজ্যিক গ্রাহকদের (হোটেল, রেস্তোরাঁ) ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। তবে সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের দাম আগের মতই প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা থাকছে।

রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু ফারুক পাইপলাইনের গ্যাসের পাইকারি মূল্য ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেন।

পাশাপাশি পাইকারি মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে খুচরা পর্যায়ে গণপরিবহনের সিএনজি ছাড়া সব স্তরেই মূল্য সমন্বয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়।

খুচরায় কতটা প্রভাব পড়ল?

খুরচা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সার কারখানার গ্যাসের দাম। এই স্তরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৬০ শতাংশ।

মূল্যবৃদ্ধির দিক থেকে এর পরেই রয়েছে গৃহস্থালির প্রি-পেইড মিটার গ্রাহকদের খরচের মূল্যবৃদ্ধি। এই স্তরে দাম বেড়েছে ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এত দিন বিদ্যুৎকেন্দ্র (সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল) যে দামে গ্যাস কিনত, এখন তার চেয়ে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি দিতে হবে। আবার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক বলেন, “সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে কোনো উৎপাদন পর্যায়ে সরকার আর ভুর্তুকি দেবে না। ভর্তুকি যা দেওয়া প্রয়োজন তা কৃষক পর্যায়ে দেওয়া হবে। সে কারণেই আগের মত সারকারখানাগুলোতে ভর্তুকিতে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে না।”

নতুন মূল্য হারে শিল্পের গ্রাহকদের বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প- এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। বৃহৎ শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ, মাঝারি শিল্পে ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র শিল্পে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ।

চা বাগানের জন্য সরবরাহ করা গ্যাসের দামও সাড়ে ১১ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯৩ পয়সা করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক বা হোটেল রেস্তোরাঁয় গ্যাসের খরচ বাড়ছে ১৬ শতাংশ।

এই ছয় স্তরের বাইরে সিএনজি স্টেশনের গ্যাসের দাম আগের মতই প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা রাখা হয়েছে, যা একমাত্র স্বস্তির খবর।

এ বিষয়ে কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ক্ষেত্রে দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। তাদের যুক্তি ছিল, এই খাতে দাম ইতোমধ্যে বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া দাম বাড়ালে গণপরিবহনে এর প্রভাবের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।”

গ্যাসে মূল্য এর আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১ জুলাই। তিন বছরের মাথায় তা আবার বাড়ানো হলো।

পেট্রোবাংলার পাশাপাশি ছয়টি বিতরণ সংস্থাও মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল গত জানুয়ারি মাসে। ওই প্রস্তাবের ওপর গত ২১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত গণশুনানি হয়। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত অংশীজনদের লিখিত মতামত দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল।

কেন দাম বাড়ানো হল?

বিইআরসির সচিব খলিলুর রহমান খান বলেন, “এনার্জি খাত সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও বৈশ্বিক বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে ভোক্তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। শুনানি ও শুনানি পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।”

বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক বলেন, এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটাতে পেট্রোবাংলার জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে ৩৩০০ কোটি টাকা, বিতরণ সংস্থাগুলোর করপরবর্তী মুনাফা থেকে ১৭ শতাংশ হিসাবে ২৫০০ কোটি টাকা এবং সরকারি ভর্তুকি হিসেবে ৬০০০ কোটি টাকাসহ মোট ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দিতে হয়।

“এটা বিবেচনায় নিয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিদ্যমান ভারিত গড় মূল্যহার প্রতি ঘনমিটার ৯ দশমিক ৭০ টাকা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ দশমিক ৯১ টাকা করা হয়েছে।”

বিইআরসির কারিগরি কমিটি ক্যাপটিভ পাওয়ারের ক্ষেত্রে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা দাম নির্ধারণের কথা বললেও চূড়ান্ত ঘোষণায় তা কেন ১৬ টাকা করা হল, সেই প্রশ্নে রাখেন বাংলাদেশ টেক্সাটইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন।

উত্তরে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কমিশন গঠিত টিম। তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত দিতে পারে। কিন্তু কমিশনের সিদ্ধান্তে সব সময় তার প্রতিফলন ঘটে না।

মহামারীর প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। অন্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশকেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এ পরিস্থিতিতে জনজীবনে যেন বিরূপ কোনো প্রভাব না পড়ে তা কমিশন ‘গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ’ করেছে। তাছাড়া এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএও দাম কিছুটা বাড়ানোর পক্ষে ছিল।

“তবে তারা বলেছে, এমন কিছু যেন করা না হয়, যাতে রপ্তানি খাত ও শিল্পের ওপর বড় রকমের আঘাত আসে। আমরাও সব মানুষের স্বার্থ চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইউটিলিটিগুলোর অর্থিক অবস্থা এবং ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গেও পর্যালোচনা করা হয়েছে।”

কমিশনের সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, “কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনে কিছু কিছু জেনুইন খরচ অন্তর্ভুক্ত করেনি। যেমন এলসি কমিশন, অ্যাডভান্সড ইনকাম ট্যাক্স। কমিশন সব বিষয় বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করেছে। সে কারণে তাদের ইভালুয়েশনের চেয়ে আমাদের খরচ একটু বেড়েছে।”

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *