রোহিঙ্গা আশ্রয়: বিপন্ন উখিয়া-টেকনাফের জীব-বৈচিত্র্য

রোহিঙ্গা আশ্রয়

ইসলাম মাহমুদ, কক্সবাজার প্রতিনিধি : বন কেটে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল নির্মাণের কারণে বনাঞ্চলে দিন দিন কমছে প্রাণীর বিচরণ। হারিয়ে যাচ্ছে বানর, বনমোরগ, বনরুইসহ নানা প্রাণী। খাদ্য ও আবাস সংকটে বারবার লোকালয়ে চলে আসছে হাতি।

আর রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন ও জ্বালানির জন্য প্রতিদিনই উজাড় হচ্ছে একরের পর একর বনভূমি। ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি ও বড় বড় পাহাড়। নানা সমস্যার মুখে পড়ছে স্থানীয়রা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা কখনোই পূরণ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার পাশাপাশি পর্যটন সম্ভাবনাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে মানবিক কারণে আশ্রয় পাওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন সবদিক থেকে বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে দেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি বিলুপ্ত হচ্ছে বনাঞ্চলও।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা আসার পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৮ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এতে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। প্রাণীবিদরা বলছেন, শুধু বনভূমিই ধ্বংস নয় এতে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী।

বাংলাদেশ প্রাণী বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, “উখিয়া-টেকনাফের বনাঞ্চলে বানর, ক্যামেলিয়ান, বনরুই, সজারু, বনগাই, ময়ূর, বনমোরগসহ নানা প্রজাতির প্রাণী অনেক চোখের বাইরে চলে গেছে। যা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কারণে এলাকায় সেসব বন্যপ্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে।”

অতিরিক্ত মানুষের চাপে কক্সবাজার জেলার নদী ও খালে যেমন দূষণ বাড়ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের পরিবেশও। এতে এসডিজি বাস্তবায়ন এবং সমুদ্র অর্থনীতিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করেন সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে প্রচুর ভূমি ধস ও ভূমি ক্ষয় হয়েছে। এটি হচ্ছে মাটিতে কোনো উদ্ভিদ না থাকার কারণে। উপকূলীয় বনাঞ্চল না থাকার কারণে বিশেষ করে এখানে যে অর্গানিক মেটার তৈরি হয় সেটা কিন্তু মাছের খাদ্য। এটি কিন্তু ধীরে ধীরে অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। অদূর অবিষ্যতে ফিরে আসার কোনো সম্ভবনা নেই।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ। যেখানে রাস্তার দু’পাশে দেখা যেতো বড় বড় পাহাড়ে ছোট-বড় গাছ-গাছালি আর সবুজে ঘেরা ফসলি জমি। কিন্তু গত দু’বছর ধরে আর সে দৃশ্য চোখে পড়েনা। এখন শুধু তাকালেই দেখা যায় ক্ষতচিহ্ন আর রোহিঙ্গাদের বসতি। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে গাছ-গাছালি, পাহাড় ও ফসলি জমি ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে ইচ্ছামত বসতি ও স্থাপনা। এতে বিপন্ন উখিয়া-টেকনাফের জীব-বৈচিত্র্যও।

এড. আবুহেনা মোস্তফা কামাল বলেন, “দিন দিন রোহিঙ্গার সংখ্যাও বাড়ছে। এতে পরিবেশের উপর চাপও পড়ছে। ফলে এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হবে।

পরিবেশ কর্মী ইব্রাহীম খলিল মামুন বলেন, “রোহিঙ্গারা রান্না জন্য বন উজাড় করছে। এছাড়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার পয়ঃবর্জ্যে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে। তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে স্থানীয়দের বসবাস করা কঠিন হবে।

এদিকে সম্প্রতি উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এসময় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপনের কারণে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি পুরোপুরি পুষিয়ে নেয়া কোনভাবে সম্ভব নয়। তবে যতটুকু সম্ভব এই ক্ষতি পরিমাণ, ধারণ নির্ধারণে কাজ শুরু হয়েছে। তা পুষিয়ে নিতে কি করা দরকার বিশেষজ্ঞরা কাজ করবেন।

বন বিভাগের হিসাবে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের সাড়ে ছয় হাজার একর বনভূমিতে। তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, এখন দশ হাজার একর বনভূমি ছাড়িয়েছে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *