নব্বই দশকের তুখেড় ছাত্রনেতা ও চট্টগ্রামে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের শাসন আমলে ছাত্রলীগের জনপ্রিয় নেতা রাশেদুল আলম রাশেদ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। করোনা মহামারীতে সাধারণ মানুষের কাতারে গিয়ে আর্থিক ও ভোগ্যপণ্য দিয়ে অনেকের নজর কাড়া সাবেক এ ছাত্রনেতা প্রতিনিয়ত দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়া বিগত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে মেয়র পদে জয়লাভকারী রেজাউল করিম চৌধুরী ও একাধিক কাউন্সিলরের জন্য ভোট কামনা করে সকলের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন তিনি।
এক সময়কার এরশাদ সরকারের পেটুয়া বাহিনীর হামলা-মামলা ও কারা ভোগের এক পর্যায়ে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে কানাডায় পাড়ি জমালেও সেখানে আওয়ামী রাজনীতি থেকে দূরে থাকেননি। টানা ১৫ বছর কানাডা বঙ্গবন্ধু পরিষদ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় দীর্ঘ দেড়যুগ কানাডায় অবস্থানের পর ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আবার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জোরালো ভূমিকা রেখে চলেছেন সাবেক এ নির্যাতিত ছাত্রনেতা।
স্বৈরাচার হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আমলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মি যখন হামলা- মামলা ও নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপনে বা গৃহছাড়া,তখন রাশেদুল আলম রাশেদ সরকারী দলের ক্যাডার বাহিনীর কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক এবং আওয়ামী ঘরানার লোকজনের কাছে ছিলেন সাহস ও নির্ভরতার প্রতীক।
১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্ণেল ফারুক রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়ে এরশাদের সরাসরি ইন্ধন ও প্রশ্রয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে সমাবেশ করতে এলে কয়েক’শ পুলিশের কর্ডন ভেঙে সেই সমাবেশ পন্ড করে দিয়ে রাশেদুল আলমের নাম একেবারে সামনের কাতারে চলে আসে।
জানা যায়, রাশেদুল আলম ১৯৮৩ সালে হাজ্বী মোহাম্মদ মহসিন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যায়নরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ধুত হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগরী শাখার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তৎকালীন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শ্রদ্ধেয় আক্তারুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর, দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বলে সাবেক ছাত্রনেতারা জানান।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে নেতৃত্বের কোন্দল করে স্বৈরাচারী এরশাদ প্ররেয়াচনায় দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাকশাল গঠন করেন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে বিভক্ত করে বিভিন্ন অপপ্রচার ও অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। চট্টগ্রাম শহরে রাশেদুল আলম ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের দিয়ে তাদের কঠোরভাবে প্রতিরোধের পাশাপাশি এক পর্যায়ে তাদের আন্দরকিল্লাস্থ দলীয় অফিস বন্ধ করে দেন।
আওয়ামী লীগের আরেক ত্যাগী নেতা জানান, ১৯৮৫ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিতর্কীত উপজেলা নির্বাচনের ঘোষণা দিলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখান করেন এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম এ মান্নান এবং চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশে রাশেদুল আলম এবং চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন অন্যতম নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ, কফিক উদ্দিন, সফিক আদনান ও ফয়জুল্লাহ বাহাদুরসহ সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এমনকী রাজপথে প্রতিহত করেন।
এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় রাশেদুল আলমকে অস্ত্র-বিস্ফোরক মামলা দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির যৌথভাবে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদেরকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিলে তৎকালীন মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ডাক্তার নাসির এসে রাশেদুল আলমকে এ বিষয় অবহিত করেন। ঐ রাতেই রাশেদুল আলম নগর ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদেরকে নিয়ে পুনরায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সাহসিকতার সাথে ছাত্রশিবির ও জাসদ ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেন।
১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম নগর ইসলামী ছাত্রশিবির আন্দরকিল্লায় তৎকালীন এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনীর ছাত্রছায়ায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সভার আয়োজন করলে রাশেদুল আলম ওই সভা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। একই সাথে রাশেদুল আলম দলবল নিয়ে সভা চলাকালীন সময়ে মিছিল সহকারে হামলা চালিয়ে ওই সভা পন্ড করে আলোচনায় আসেন। এ ঘটনায় দুজন শিবির কর্মী নিহত হলে রাশেদুল আলমের বিরুদ্ধে জোড়া হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৭ সালের এপিলে রাশেদুল আলম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি বহর নিয়ে এক সভায় যাওয়ার প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নাম্বার সড়কের মুখে তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় ছাত্রসমাজ (স্বৈরাশাসক এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনী) সভাপতি জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী রাশেদুল আলমকে হামলা করলে ভাগ্যক্রমে তিরি প্রাণে বেঁচে যান এবং সন্ত্রাসী জসিম নিহত হয়। এ ঘটনায় রাশেদুল আলমের সাথে ছিলেন তৎকালীন নগর ছাত্রলীগ নেতা ফয়জুল্লাহ বাহাদুর, আব্দুল মোনায়েম, সুরজিত দাস ও ছোটনসহ অন্যান্যরা। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন স্বৈরাশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের লালদিঘা মাঠে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ডাক দেয়া সভায় শেখ হাসিনা যোগ দিতে আসলে রাশেদুল আলমসহ অন্যান্যরা শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে থেকে রিসিভ করে সভার কাছাকাছি আসলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এলাপাতাড়ি গুলি চালায়।
এ সময় শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও মূহুর্তেই ২৪ জন ছাত্র-জনতার প্রাণ নিভে যায়। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী কর্ণেল ফারুক রহমান, খুনী ফারুক চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজের পার্শ্ববর্তী খালি প্রাঙ্গণে এক জনসভার আয়োজনের ঘোষণা দিলে তৎকালীন দলীয় হাই কমান্ডের নির্দেশে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়।
ওই দিন বিকেল ৩ টায় রাশেদুল আলমসহ অন্যানরা কাজীর দেউড়ি মোড়ে জামায়েত হন। ঐদিন রাশেদুল আলমের সাথে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বখতেয়ার উদ্দিন খান, ফখরুদ্দিন চৌধুরী বাবর, মুজিবর রহমান, সফিক আদনান, শেখ আতাউর রহমানসহ অনেকেই। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের হাজারো পুলিশ বাহিনী সভাস্থল ও পুরো এলাকা ঘেরাও করে রেখেছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মিছিলসহকারে এগিয়ে গিয়ে সভা পন্ড করার কোন উপায় না দেখে রাশেদুল আলম মোটর সাইকেলে তার দুজন সঙ্গী নিয়ে আচমকা পুলিশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে সভামঞ্চের খুব কাছাকাছি গিয়ে হামলা চালায় এবং সভা চক্রভঙ্গ হয়ে যায়। হামলা শেষে তারা দ্রুত পালিয়ে আসেন।
এছাড়া ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের দিন রাশেদুল আলম চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আ’লীগের দলীয় প্রার্থী আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিনের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে তৎকালীন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সন্ত্রাসীদের ছোড়া বোমা হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন।
১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলামের সভা পন্ড করে আসার পর সন্ধ্যায় মোমিন রোড থেকে গ্রেফতার হন। ১২টি মামলা ও অবৈধ আটকাদেশসহ রাশেদুল আলম এক নাগাড়ে ১৮ মাস কারাবরণ করেন। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবারও রাশেদুল আলম গ্রেফতার হন এবং ১৯৯০ সালের মার্চে মুক্তি লাভ করেন।
অন্যদিকে মামলা-হামলায় অতিষ্ট হয়ে ১৯৯০ সালের ১০ নভেম্বর রাশেদুল আলম দেশত্যাগ করেন। ২০০১ সালে তিনি ফের দেশে ফিরে এসে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সক্রিয় হন। এ সময় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান এবং হাটহাজারী বিএনপি সাবেক সংসদ ওয়াহিদুল আলম রাশেদুল আলমকে আবারও দেশ ত্যাগ করার জন্য হুমকি দেন।
রাশেদুল আলমও তাদেরকে পাল্টা হুমকি দিলে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে রাশেদুল আলমকে মোমিন রোড থেকে গ্রেফতার করে মিথ্যা অস্ত্র মামলায় কারাগারে প্রেরণ করলে আট মাস কারাভোগ করে মুক্তিলাভ করেন। রাশেদুল আলম মুক্তি লাভের পর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালালে ২০০৪ সালে খালেদা জিয়া সরকার অবৈধ বাহিনী দিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদেরকে হত্যা করা শুরু করলে রাশেদুল আলম আবারও কানাডায় পালিয়ে যান।
কানাডায় দীর্ঘ ১৫ বছর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে কানাডার রাজধানী অটোয়াস্থ তৎকালীন খালেদা সরকারের দূতাবাসও ঘেরাও করেন।
জে-আর
Leave a Reply