দীর্ঘদিন ধরে সরঞ্জাম সংকটে ধুকছে দেশের রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম সার্ভারে সমস্যা, অবকাঠামো সংকট এবং রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পর্যাপ্ত জনবল সংকটে লেগেই আছে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতা। এসব সংকটে কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় বাড়ছে ধীরগতি। ফলে পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে আমদানিকারকদের। এতে করে বিপাকে পড়ছেন তারা।
প্রতিষ্ঠার শতবছরে রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি এলেও সেবা প্রদানের দিক থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস পিছিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বর্তমানে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত হাজার বিল অব এন্ট্রিও জমা পড়ছে কাস্টমসে।
তবে সেবা প্রদানের দিক থেকে কাস্টমসের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকটের পাশাপাশি সার্ভার সমস্যার কারণে কিছুটা সমস্যা হয়। তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে বলেও দাবি তাদের।
দেশের আমদানি-রপ্তানি থেকে শুরু করে সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ আসে চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে। গত অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব খাতে ৫৯ হাজার ২’শ ৫৬ কোটি টাকার যোগান দিয়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ আর্থিক সংস্থাটি।
বন্দরে পণ্য আসার পর বিল অব এন্ট্রি থেকে শুরু করে কাগজপত্র দাখিল, পণ্যের চালান পরীক্ষা, মূল্যায়ন, শুল্ক-কর পরিশোধের কাজ শেষ করতে হয়। এসব কাজ শেষ করা আমদানিকারকের জন্য সময় সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে।
স¤প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রকাশিত টাইম রিলিজ স্টাডি ২০২২-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে আমদানি পণ্যের চালান খালাসে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গড়ে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সময় লাগে। আর বেনাপোলে ১০ দিন ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিট এবং ঢাকায় ৭ দিন ১১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট সময় লাগে।
২০১৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমসে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের প্রায় সবকিছুই অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই কেন্দ্রীয় সার্ভার সিস্টেম মাইগ্রেশনের কারণে দিনভর শুল্কায়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমদানিকারকদের। চলতি বছরের শুরুর দিকে একাধিকবার সার্ভারের ত্রæটির কারণে শুল্কায়ন কার্যক্রম টানা বন্ধ ছিল। এখনো সে সমস্যা রয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে কোন পরীক্ষক নেই। ১২ জন পরীক্ষকের পদ থাকলেও বর্তমানে সবগুলো পদই শূণ্য রয়েছে। একজন সহকারী পরীক্ষক দিয়েই চলছে বর্তমান কার্যক্রম। পরীক্ষাগারে শুধু জনবল সংকটই নয়, অভাব রয়েছে পর্যাপ্ত সরঞ্জামেরও। ফলে ফরমালিন ও সাইট্রিক এসিড ছাড়া বর্তমানে কোনো ধরনের রাসায়নিক পরীক্ষা হয় না কাস্টমসের ল্যাবে।
কাস্টমসের শীর্ষ পদেও রয়েছে বড় সংকট। প্রথম শ্রেণির পদে ২’শ ১০ কর্মকর্তার বিপরীতে ১’শ ১৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪’শ ৯৬ পদের বিপরীতে কাজ করছেন ২’শ ৫৮ জন। অতিরিক্ত কমিশনার পদে দুজন থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন ১ জন ও ৪৭ জন সহকারী কমিশনার পদের বিপরীতে ৩০ জন কর্মরত আছেন।
পাশাপাশি তৃতীয় শ্রেণির পদে ৪’শ ২৩ জনের বিপরীতে ১’শ ৬৮ জন ও তৃতীয় শ্রেণির পদে ১’শ ১৮ জনের বিপরীতে ৬৫ জন কর্মচারি কাজ করছেন।
অপরদিকে উপ-প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক, প্রোগ্রামার, সহকারী পরিচালক (পরিসংখ্যান), প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান অনুসন্ধায়ক, অডিটর, ডাটা এন্ট্রি অপাররেটর, স্পীড বোড ড্রাইভার, রেকর্ড সাপ্লাইয়ার ও কুক পদে কোন জনবলই নেই।
আমদানিকারকরা বলছেন, সার্বিকভাবে সেবা প্রদানে বন্দরের সার্বিক উন্নয়ন হলেও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে সেবার মান উন্নত হয়নি। বিশেষ করে পণ্য ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি নেই। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় ধীরগতি হবার কারণে উৎপাদন খরচও বাড়ছে বলে দাবি করছেন তারা।
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন কোন বিদেশি ক্রেতার (বায়ার) কাছ থেকে কাজের অর্ডার পাই তখন আমরা পণ্য উৎপাদনের জন্য এক মাস সময় পাই।
কিন্তু কাস্টমসের মাধ্যমে কাঁচামাল খালাস করতেই আমাদের ১২ দিন সময় চলে যায়। পোশাক খাত জিডিপি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাই শুল্কায়ান প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা বাড়ালে আমদানিকারকরা অনেক বেশি উপকৃত হবে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, জনবলের অভাব ও সার্ভারে সমস্যার কারণে শুল্কায়নের কাজ বিঘিœত হচ্ছে। এসব সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারলে কাস্টমস আরও গতিশীল হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন জাহাজ জটমুক্ত। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হলে পণ্য খালাসও দ্রæত হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. আবু নুর রশিদ আহমেদ বলেন, পণ্য ছাড়ে বর্তমানে কিছুটা বেশি সময় লাগছে। একদিকে জনবল সংকট, অন্যদিকে মাঝে মাঝে সার্ভারে সমস্যা। তবে যাবতীয় সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চলছে।
জে-আর/জে-এম
Leave a Reply