একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, এ দেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রমুখ, রাজশাহীতে দেশের প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভুবন মোহন পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্বোধক, রাজশাহীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা, বর্ষিয়ান আইনজীবী, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নাম রাজাকারের তালিকায় দেখে সবমহল বিস্মিত, তিনি নিজেও হতবাক বিস্মিত।
রাজাকারের তালিকায় নাম আসার বিষয়ে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ‘আমি এটা শুনে বিস্মিত হয়েছি। এটা কি করে সম্ভব? আমি জীবনে কখনো ওদের লাইনে যাইনি। রাজাকারের তালিকায় আমার নাম আসবে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এটার শক্ত প্রতিবাদ করবো।’
এক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, অন্যভাবে সমাধান না হলে, আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নেব। সারা জীবন বাঙালি, দেশের জন্য লড়াই করেছি। এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।
গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ‘সারা জীবন দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাটিয়ে দিলাম। আর আজ এই অভিযোগ পেলাম। আমি ব্যথিত, মর্মাহত। আমি বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি এবং কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিতে চাই না। আমি কোনো দুর্বলতা দেখাতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় যে ধরনের কাজ করার কথা, তা যথাযথভাবে করতে পারছে না। আমি অন্তত তাই মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী যদি গোলাম আরিফ টিপু, সালাম ভাই, মহসিন ভাইকে রাজাকার বানায়, তাহলে কার কাছে কী বলব! অথচ আমরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মূল শক্তি। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। আর আজকে আমাকে রাজাকার বানালো হলো?’
কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন,‘চিন্তা করছি। অন্যভাবে সমাধান হলে ভালো। নইলে আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নেব। পাক বাহিনীর তালিকা হতে পারে বলে মন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দায় এড়াতে পারবেন না। এই প্রশ্নে আমরা রাষ্ট্রের অবস্থান দেখব।’
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে রোববার (১৫ ডিসেম্বর) ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে রাজশাহী বিভাগের ৮৯ নম্বর তালিকায় (ক্রমিক নম্বর ৬০৬) নাম রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুসহ পাঁচজনের নাম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই পাঁচজন এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। আবার তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট মহসিন আলীর নামও রয়েছে তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের নামও রয়েছে তালিকায়। তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত হন। ওই সময় আব্দুস সালাম পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে ভারত পালিয়েছিলেন।
রাজশাহী বিভাগে স্বাধীনতাবিরোধীদের এক থেকে ১৫৪টি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তালিকায় কয়েক শ ব্যক্তির নাম রয়েছে। যাদের কয়েকজনের নাম দ্বিতীয়বারও রয়েছে।
৮৯ নম্বর তালিকায় থাকা পাঁচজনের মধ্যে অপর দুজন হলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেব। যদিও এই ৮৯ নম্বর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল। এর বাইরে কোনো তথ্য নেই। সেই হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, এই পাঁচ ব্যক্তি রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না বলেই তাদের অব্যাহতি দিতে আবেদন করা হয়েছিল।
তালিকায় এসব ব্যক্তির নাম যেভাবেই আসুক না কেন সেটি লজ্জাজনক বলে দাবি করেছেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের পরিবারের সদস্য আরিফুল হক কুমার।
তিনি বলেন, ‘এই তালিকায় কেন আসবে এসব ব্যক্তির নাম। যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, আবার যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর—তার নাম কেন আসবে। হয়তো রাজাকাররা এই তালিকা তৈরিতে কাজ করেছেন।’
রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তাদের নামও যদি তালিকায় থাকে, সেটিও হবে চরম লজ্জাজনক। কেন তাদের নাম এ তালিকায় উঠে এলো, কোন প্রসঙ্গে এলে তা বিস্তারিত উল্লেখ নাই।’
তবে তালিকায় অনেক প্রকৃত স্বাধীনতাবিরোধীর নাম স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন ডিন আহম্মেদ মোহাম্মদ প্যাটেল (তিনি কানাডায় রয়েছেন), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন, ড. মোহাম্মদ ওয়াসিম, জিল্লুর রহমান, রাজশাহী নগরীর খোরশেদ আলম, আব্দুস সোবহান, খন্দকার আব্দুল বাকি প্রমুখ।
নাম আছে কিন্তু ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি—এমনও রয়েছে তালিকায়। এঁদের মধ্যে ৩৮ নম্বর তালিকায় নজির আহমেদ, ৪৮ নম্বরে দলিলুর রহমান প্রমুখের শুধু নামই রয়েছে।
৪১ নম্বর তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে রাজশাহী জেলার সিংড়া থানার অন্তর্গত ভুল বাড়িয়া গ্রামের আব্দুল আজিজ কর্তৃক রাজাকার ও দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু কাদের নামে অভিযোগ করা হয়েছিল তাঁদের নাম উল্লেখ নেই তালিকায়।একই রকম অবস্থা আরো কয়েকটি ক্রমিক নম্বরে।
৪৪ নম্বর তালিকায় রাজশাহীর রাজাকার খোরশেদ আলম কর্তৃক দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বলা হলেও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আহম্মেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী মনে করতেন রাজাকাররা। তাহলে রাজাকার খোরশেদের করা অভিযোগ কি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এটি হাস্যকর। যদিও আমি তালিকাটা দেখিনি।’
রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের দাবি, এ তালিকা সম্পূর্ণ নয়। এটি ওই সময়ের তালিকার একটি খসড়া হতে পারে। আবার কপি পেস্টও হতে পারে। কোনো অনুসন্ধান ছাড়ায় যাচ্ছে, তাই সেভাবেই নামগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু সরকার এটিকে রাজাকারের তালিকা বলছে, কাজেই এখানে কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এ রকম ব্যক্তির নাম উঠে আসা বাঞ্ছনীয় নয়। এটি মেনে নেওয়া যায় না।
Leave a Reply