ফটিকছড়ি প্রতিনিধি: ফটিকছড়িতে জুড়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন নদী,খাল ও জলাশয় থেকে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন দিয়ে দিনরাত বালু উত্তোলন করছে দুর্বৃত্তরা। ফলে একদিকে যেমন পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও জমিতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হচ্ছে। ইজারা বহির্ভূত যত্রতত্র স্থান থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তেমনি ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দে স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে জানা যায়, ড্রেজার মেশিন ও বালু পরিবহনে ব্যবহৃত ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরের বিকট শব্দে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। যত্রতত্র বালু উত্তোলন জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। রাত-দিন সবসময় চলে এই অবৈধ বালু পাচারের উৎসব। ফলে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সেতু-কার্লভাট, নষ্ট হয়ে ক্রমান্বয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ধুলোবালির স্তুপ এলাকার বায়ুদূষণসহ সার্বিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের জুগিনাঘাটা, বেড়াজালী এলাকার চম্পাপাড়া, শ্বেতকুয়া এলাকার গজ্জেম্মে টিলা এলাকা, কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের চেঙ্গেরকুল, ফরেস্টর অফিস, পাল্লান পাড়া ও চুরখাঁহাট এলাকা, ফটিকছড়ি পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ড উত্তর রাঙ্গামাটিয়া এলাকা, পূর্ব সুয়াবিল হালদাপাড়, ভূজপুর ইউনিয়নের হরিণাকুল, নারায়ণহাট ইউনিয়নের জুজখোলা ও দাঁতমারা, ধর্মপুর, খিরাম ইউনিয়নে, ধুরুং, হালদা ও সর্তাখালসহ বিভিন্ন নদী-খাল থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করে ট্রাক ও ড্রামট্রাকসহ ছোট-বড় গাড়ীতে করে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছে একটি শক্তিশালী বালু ও মাটি সিন্ডিকেট।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের জুগিনাঘাটা এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন উপজেলা প্রশাসন ৭ নভেম্বর। এ সময় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত একটি এক্সক্যাভেটর ও একটি ট্রাক্টর জব্দ করা হয়। যা গত ১৪ নভেম্বর জব্দকৃত এক্সক্যাভেটর এর মালিক হাজির হয়ে দোষ স্বীকার করায় তাকে বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী ২ লক্ষ টাকা জরিমানা দন্ড করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল যোগসাজশে এসব বালু উত্তোলন হয়। যার কারনে স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ট হলেও প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পারছেন না। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ বারবার থেকে অভিযানের পরও থামছে না বালু উত্তোলন।
স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) এক জায়গায় বালু তোলা বন্ধ করলে, বালু উত্তোলনকারী অন্য জায়গায় বালু তোলা শুরু করেন। আবার বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়ে মেশিন বা সরঞ্জামাদি জব্দ করা হলেও, উত্তোলিত বালু বিক্রিতে বাধাগ্রস্ত হতে হয় না বালু উত্তোলনকারীদের। ফলে এক জায়গায় বালু তোলা বন্ধ করতেই তাঁরা অন্যস্থানে বালু তোলা শুরু করে। এসব বালু উত্তোলনকারীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন জায়গা থেকে বালু তোলেন এবং দিন রাতে ট্রাক, পিক-আপসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে বিক্রি করে আসছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ওই সব এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক স্থান থেকে দীর্ঘদিন বালু তোলার ফলে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
ইউএনও কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ৭ মাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ১০ টি মামলায় সর্বমোট ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাব্বির রাহমান সানি। দিনে বা গভীর রাতে পরিচালিত এসব অভিযানে বালু উত্তোলন বা মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু এক্সক্যাভেটর, ড্রেজার মেশিন, ট্রাক্টর, পিক আপ ভ্যান জব্দ করা হয়। জব্দকৃত প্রায় সব সরঞ্জাম জরিমানা আদায় সাপেক্ষে অবমুক্ত করা হলেও এখনো একটি এক্সক্যাভেটর, একটি ট্রাক্টর ও কিছু ড্রেজার মেশিন রয়েছে জানা গেছে ।
নদী ও খাল থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর কতটুকু প্রভাব পড়ছে তা জানতে চাইলে হালদা গবেষক ও চট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নদী থেকে অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যায় ফলে নদীর ক্ষয় বেড়ে গিয়ে নদীর পাড় ভাঙ্গন ত্বরান্বিত করে। এছাড়াও অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশের বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে । যার প্রভাবে তলদেশে বসবাসকারী উদ্ভিদ ও প্রাণিগোষ্ঠীর আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হবে তেমনি ধ্বংস হয়ে যাবে এদের খাদ্যের উৎসসমূহ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মৎস্য সম্পদের প্রজনন প্রক্রিয়ায়। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠন প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং কমে যাবে নদী পাড়ের মাটির গুনাগুন ও কর্মদক্ষতা।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাব্বির রাহমান সানি বলেন, আমি ফটিকছড়িতে যোগদানের পর থেকে এমপি মহোদয় ও ডিসি স্যারের নির্দেশে অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে একের পর এক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। পুরো উপজেলাজুড়ে অভিযান চলমান, অভিযোগ পেলে যেকোনো মূহুর্তে অভিযান পরিচালনা করা হবে।পরবর্তীতে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন এবং জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
Leave a Reply