পুষ্টি খাতে বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই প্রশংসনীয়ঃ বিভাগীয় কমিশনার

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিন বলেছেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখন দরকার গুণগত মান বাড়ানো, যা পুষ্টি নিশ্চিত করবে। পুষ্টি খাতে বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই প্রশংসনীয়। অপুষ্টি নিরাময়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সহজতর হয়। এর ফলে ক্ষুধা নিবারণ ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। পুষ্টিমান বাড়াতে অনেক এলাকায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের টিফিন দেওয়ার মতো চমৎকার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। পুষ্টিবান জাতি গঠনে আমাদেরকে অনেক কাজ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ভোক্তাদের এমনভাবে সমন্বয় ঘটাতে হবে যেন নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য সবার জন্য সুলভ করা যায়। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কাজ করছি। সকলের সমন্বিত উদ্যোগে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টিবান জাতি গঠন সম্ভব।

আজ ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় বহুখাত ভিত্তিক রিসোর্স টিমের (ডিএমআরটি) প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণে রিসোর্স পার্সনদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় প্রোগ্রামের আয়োজন করেন।

তিনি বলেন, দূষিত পানি বা দুর্বল স্যানিটেশন ব্যবস্থা মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা তৈরি করে। এসবের প্রভাব একজন ব্যক্তির ওপর দীর্ঘমেয়াদি। নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা না গেলে ক্যান্সারসহ জঠিল রোগীর সংখ্য বাড়বে। অপুষ্টির মূল কারণ সঠিক পরিমাণ ও সঠিক পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য খেতে না পাওয়া। ক্ষুধা নিবারণের হার ও ভাত গ্রহণের মাত্রা কাঙ্খিত পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে, তবে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ডিম, দুধ, ফলমূল ও ডালজাতীয় শস্য গ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, আমরা সরকারি-বেসরকারি খাতসহ সুশীল সমাজের সঙ্গে কাজ করছি যেন সব মানুষের খাদ্যব্যবস্থার মধ্যে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা অর্জিত হয়। এ জন্য আমরা ভোক্তার দিকেও নজর দিচ্ছি। কেননা, দুর্বল বা পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণহীন খাদ্যাভ্যাস কেবল ব্যক্তির সীমিত আয়ের কারণেই গড়ে ওঠে না। এ ব্যাপারে ব্যক্তির অজ্ঞানতা বা অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএনএনসি) ২২টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে, যেগুলো পুষ্টি কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গর্ভবতী নারীদের পুষ্টি ও মনো-সামাজিক বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। এর মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কের সার্বিক গঠন নিশ্চিত করা যাবে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ রোধে সর্বত্র জনমত সৃষ্টি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রের খাদ্যব্যবস্থায় পুষ্টির ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে দেখেছি, এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে কর্মীদের মধ্যে রক্তশূন্যতা পূরণে ভালো ফল পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মক্ষেত্রে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য বা কোথাও কোথাও কোনো ধরনের খাদ্যব্যবস্থাই নেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের বিষয়ে যত্নশীল হলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে অপুষ্টির ব্যাপারে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে। তবে আমাদের অপুষ্টি, অতিপুষ্টি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো আরও যে সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলোও মোকাবিলা করতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ডা. শাহরিয়ার কবীর আরও বলেন, অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো করছে। এ ধারাকে আরও বেগবান করতে বহুখাতভিত্তিক পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এ রকম একটি বহুখাতভিত্তিক পদ্ধতির জন্য বিএনএনসির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাজ করছে। কেবল প্রত্যক্ষ পুষ্টি পদ্ধতিতে নয়, বরং পুষ্টি সংবেদনশীল পরোক্ষ পদ্ধতির ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয়, জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের গণমাধ্যম থেকেও সমর্থন প্রয়োজন। তারা আমাদের সঠিক বার্তা প্রচারে ও জনগণকে সংবেদনশীল করতে সহায়তা করব।

অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিরা বলেন, পুষ্টিতথ্য শিশুদের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরী। দেশের ৪ কোটি ২৭ লাখ শিশুকে প্রতিবছর নতুন বই দেওয়া হয়। বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদের ১০ শতাংশ জায়গাতেও যদি এসব পুষ্টি তথ্য রঙিন কার্টুনের মতো দৃষ্টিনন্দন উপায়ে তুলে ধরা যায় তাহলে ভালো ফল দেবে। খাদ্য সুরক্ষার পাশাপাশি আমাদের এটিও স্বীকার করতে হবে যে অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই সত্যিকার অর্থেই জটিল কাজ। একটি বহুখাতভিত্তিক পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইতোমধ্যে অপুষ্টি হ্রাস করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ ভালো অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বক্তারা আরও বলেন, পুষ্টি নীতিমালা ও এর বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা রয়েছে। এমন গুটিকয়েক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পুষ্টিকেও একটি নিয়ামক হিসেবে দেখার এখনই সময়। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন অংশীজন, যেমন সরকার, নীতিনির্ধারক, মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজ, উন্নয়ন অংশীদার ও দাতাগোষ্ঠীদের এখন আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা দরকার। বেসরকারি খাতের একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের পানিসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ সরকার খাদ্য ও পুষ্টি খাতের আইন ও নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নে অত্যন্ত আগ্রহী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দূরদর্শী নেতা জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। খাদ্য ও পুষ্টি খাতে সরকারের অঙ্গীকার প্রণীত আইন ও নীতিগুলোর মধ্যেই দৃশ্যমান। এর সবই এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পুষ্টিমান ও খাদ্য সুরক্ষা উন্নত করার কথা থাকবে। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে আমাদের দৃঢ় ও কার্যক্ষম জনবল দরকার হবে। আর পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে তা বাস্তবায়িত হবে না।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ’র সভাপতিত্বে ও চমেক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার দৃষ্টি শর্মার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, ইউনিসেফ’র চীফ অব ফিল্ড অফিস মাধুরী ব্যানার্জী, বিএনএনসি’র পরিচালক ডা. তাহেরুল ইসলাম খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সুমন বড়ুয়া।

পুষ্টি পরিস্থিতি ও বহুখাত ভিত্তিক ন্যুনতম পুষ্টি প্যাকেজ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস’র ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মোঃ ফজলে রাব্বি, বিএনএনসি’র উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আক্তার ইমাম ও সহকারী পরিচালক ডা. নাজিয়া আন্দালিব।

ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ড. গাজী গোলাম মাওলা, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম, মহিলা বিষয়ক উপ-পরিচালক মাধবী বড়ুয়া, কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী, নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) অজিত দেব, নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন) সালমা ফেরদৌস প্রমূখ। সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের এডিসি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, মহিলা বিষয়ক, কৃষি, খাদ্য, সমাজসেবা, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, প্রাথমিক শিক্ষা, তথ্য অফিস ও যুব উন্নয়নসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তরা ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে অংশ নেন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *