আজ ৭ জানুয়ারি। ২০১১ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারায় কিশোরী ফেলানী খাতুন। হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ন্যায়বিচার পায়নি পরিবার। মেয়ে হত্যার বিচার না পেয়ে হতাশা ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বাবা-মা। তাদের প্রশ্ন, একটি প্রমাণিত হ্ত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে এক যুগ ধরে অপেক্ষা করছি, আর কত সময় লাগবে?
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রমকালে বিএসএসের গুলিতে নিহত হয় ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানী। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে তার রক্তাক্ত মরদেহ। গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারতের সীমান্ত ‘নীতি’। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের ‘বিচারের’ ব্যবস্থা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বাহিনীর বিশেষ কোর্টে দুই দফা বিচারিক রায়ে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে খালাস দেওয়া হয়। সেই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করেন ফেলানীর পরিবার। কিন্তু আজও সে রিটের শুনানি হয়নি।
আক্ষেপ প্রকাশ করে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘আমার মেয়ে তো কাউকে আঘাত করেনি। তারপরও বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ আমার তাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করলো। বারোটা বছর পার হয়ে গেলো, তার (অমিয় ঘোষের) কোনও শাস্তি হলো না। আমার মেয়ে হ্ত্যার বিচার কেন হবে না? যার যায় সে সেটা বোঝে। অনেকেইতো বিচার পায়, তাহলে ফেলানী বিচার পাবে না কেন? বিচার পেলে মেয়েটার আত্মা শান্তি পেতো। আমরাও মরার আগে বিচারটা দেখে যাইতে চাই।’
বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা প্রকাশ করে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিচার করতে আর কতদিন লাগবে? দুই দেশের সরকার যেন দ্রুত বিচার কেরে দেয়। আমরা অমিয় ঘোষের শাস্তি দেখতে চাই।’
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘ফেলানী হত্যার পর সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন খোঁজ নিলেও এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। এক যুগ হয়ে গেলও আজও বিচার পাইনি। মেয়েকে তো আর পাবো না, দুই দেশের সরকারের কাছে মেয়ে হত্যার বিচারটা চাই।’
ফেলানী হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামে হলেও জীবিকার প্রয়োজনে পরিবার নিয়ে ভারতের বঙ্গাইগাঁও গ্রামে থাকতেন নুরুল ইসলাম। দেশে ফেলানীর বিয়ে দেবেন বলে ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি রাতের আঁধারে মেয়েকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৭ জানুয়ারি ভোরে ফুলবাড়ির অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে মই বেয়ে আসার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলি এসে বিদ্ধ করে ফেলানীর দেহ। গুলিবিদ্ধ ফেলানী কাঁটাতারের ওপর ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার নিথর দেহ কাঁটাতাঁরের ওপর ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা।
কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত মরদেহের ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফেলানী হত্যার বিচার এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। বিএসএফের এই কোর্টে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ও মামা হানিফ। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিএসএফের বিশেষ কোর্ট। পরে রায় প্রত্যাখ্যান করে পুনর্বিচারের দাবি জানান ফেলানীর বাবা।
২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় শুনানি শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আদালতে সাক্ষ্য দেন নুরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ২ জুলাই এই আদালত আবারও অমিয় ঘোষকে খালাস দেয়। রায়ের পরে একই বছর ১৪ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ও মাসুম ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন করে। ওই বছর ৬ অক্টোবর রিট শুনানি শুরু হয়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কয়েক দফা শুনানি পিছিয়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য হলেও শুনানি হয়নি। এরপর ২০১৯ ও ২০২০ সালে কয়েকবার শুনানির তারিখ ধার্য হলেও এখন পর্যন্ত তা সম্পন্ন হয়নি ।
ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারকে আইনি পরমর্শ দেওয়াসহ তার বাবার সঙ্গে একাধিকবার ভারতে যান কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী এস এম আব্রাহাম লিংকন।
এই আইনজীবী বলেন, ‘ভারতের উচ্চ আদালতে আমরা বৃহত্তর স্বার্থে রিট আবেদন করেছি। রিটটি নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। প্রত্যাশা করছি ভারতের আদালত দ্রুত রিট আবেদনটির শুনানি কার্যতালিকায় নিয়ে আসবেন এবং একটি ইতিবাচক রায় দেবেন। শান্তিপূর্ণ বর্ডার ব্যবস্থাপনাসহ পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় এখানে জড়িত রয়েছে। ফেলানী হত্যার ন্যায় বিচারের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যাশা সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নেমে আসুক। সীমান্তে যেন আর কোনও নিরপরাধ মানুষের প্রাণ না ঝরে।’
ফেলানীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় শনিবার (০৭ জানুয়ারি) দুপুরে গ্রামের বাড়িতে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করেছে পরিবার। মেয়ের পরকালীন শান্তির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেছেন ফেলানীর বাবা-মা।
Leave a Reply