বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা আমাদের সমাজে অসাধারণ সমৃদ্ধির অংশ।

শিশু শব্দটা শুনলেই মনে হয় কোমল, আদুরে কিছু। আসলে বিষয়টি এমনই। প্রতিটি পরিবারেই শিশু আনন্দের উৎস। আমাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়, যাদের শারীরিক/ মানসিক অক্ষমতা রয়েছে, সাধারণ বিকাশকে প্রভাবিত করে, সহায়তার এবং বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক বাবা-মা সুস্থ সবল শিশুজন্মহোক প্রত্যাশা করে। জন্মপূর্ব সময়ে অসতর্কতা বা জন্ম পরবর্তীতে কোনো কারণে অটিজম রোগে আক্রান্ত হয়ে, শিশু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুতে পরিণত হতে পারে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু শুধুমাত্র একটি শব্দই নয় এটি ব্যাপক অর্থ নির্দেশ করে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলতে সেই সব শিশু, সমবয়স্কদের তুলনায় যাদের বুদ্ধি সংবেদন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ভাব বিনিময়, আদানপ্রদানের সক্ষমতা কম / বেশি হয়। তাদের জন্য বিশেষ যত্ন ও শিক্ষার ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়।

আমাদের সামাজিক পরিস্থিতিতে দেখা যায়, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু কাউকে দেখলেই অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তখন সমাজের সব নিয়ম যেন ভুলে গিয়ে, বিশেষ সক্ষম এই শিশুদের কথা ভুলে যাই। কোনো নিয়ম তখব মানি না, অটিজম আক্রান্তদের ছোট করে দেখি। তাদের নিয়ে হাসাহাসি করাও সমাজের এক নিষ্ঠুরতা ও অসভ্যতার পরিচয় দিতে দেখা যায়। এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন/ অটিজম কোনো প্রতিবন্ধিতা নয়, এটি একটি বর্ধনমূলক বৈকল্য, যা শুধু শিশুদের বয়স থেকে চিহ্নিত হয়। স্নায়ুর বিকাশজনিত এই বৈকল্য কেন হয়, এই প্রশ্নের কোনো সর্বজনস্বীকৃত উত্তর গবেষকরা এখনো খুঁজে পাননি। সমস্যাটি মস্তিষ্কজাত, যা একটি শিশু জন্মের সময়ই বহন করে নিয়ে আসে, যেটি তার শৈশবকালীন বিকাশকে নানাদিক থেকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্নশিশুদের জীবন গঠনে বাবা-মায়ের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের নানা স্তরের মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সবাই সহযোগিতা, সহর্মমিতার ভূমিকা পালন করে না।শহরের যত সচেতনতা দেখা যায়, গ্রামজনপদে কিন্তু পরিলক্ষিত করা যায় না। গ্রামে এখনো বিশেষচাহিদা সম্পন্নশিশুকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। পাগল বলা হয়, এটি দুঃখজনক, এর বাহিরেও নানারকম কুসংষ্কার আছে, যেমন জিন বা ভূত ধরার মতো অপ্রাসঙ্গিক গল্প। সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার সংবাদছাপা হয়।বেশির ভাগ সময় শিশুর অটিজম শনাক্তের কোনো চেষ্টা হয় না। সেই সকল পরিবারে অটিজম আক্রান্ত শিশুকে লুকিয়ে রাখা হয়। সমাজে নানাবিধ নিয়মকানুন, প্রথাগত কুসংস্কার অটিজম শিশুদের একঘরে করে রাখে। অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল গরিব পরিবারে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের আয়ের উৎস হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তির কাজে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

অটিজম আক্রান্ত শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। সমাজে এইসকল শিশুদের প্রতি সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চলাফেরা, লেখাপড়া, খেলাধুলায় বিশেষ ভূমিকায় পালন করা হলে তাদের জীবন, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পরিবারগুলোর জীবনযাপন অনেক সহজ হবে, নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা মুক্তি লসভ করবে, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন ব্যবস্থায় অটিজম আক্রান্ত শিশুর মূল যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় সেটা তার অটিজম নয়, সেটা হলো বৈষম্য এবং কুসংস্কার। প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকারক্ষুন হয়, পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য। সর্বস্তরে এরূপ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত আছে, প্রতিবন্ধীত্ব অভিশাপ এবং পাপ কাজের শাস্তি যা প্রতিবন্ধীদের যত্ম, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রভাবিত করে থাকে। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা চিকিৎসা, শিক্ষার কম সুযোগ পায়। অটিজম আক্রান্ত শিশুর ইন্দ্রিয় ক্ষমতা বুদ্ধি বা শারীরিক ক্ষমতা অভিন্ন যে কারণে তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা বা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন হয়। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলতে সেই সব শিশুদের বুঝায় সমবয়স্কদের তুলনায় যাদের বুদ্ধি সংবেদন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ভাব বিনিময় ক্ষমতা ও সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রার কম বা বেশী হয় তাকেই ব্যতিক্রমী শিশু বলে আখ্যায়িত করা হয়।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ অনেকগুলো আইন প্রণয়ন করেছে ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যেমন – শিশু নীতি ২০১১, শিশু আইন ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধীর অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ সনদ (সিআরপিডি) এবং ২০০৮ সালে ঐচ্ছিক প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর অন্যতম। সিআরপিডি রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরসহ সকল নাগরিকের মানবাধিকারের পূর্ণ ও সমান অধিকার ভোগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এ সনদটি বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থার পর্যালোচনা এবং সমাজে তাদের অন্তর্ভূক্তির জন্য পদক্ষেপের ভিত্তি স্থাপন করে। এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে অটিজম ইস্যুটিকে প্রাধান্য দেওয়াসহ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে সমাজেও ধীরে ধরে বিশেষ শিশুদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা কমে আসছে। প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান সেখানে কয়েক বছর ধরে অটিস্টিক শিশুদের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা যদি তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই, একটু বিশেষ নজর দেই, তাদের মূলধারার শিক্ষায় নিয়ে আসা সম্ভব।আর দশটি সুস্থ শিশুর মতো তারাও সমাজের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সফলতার পরিচয় দিতে সক্ষম-তারা সংসারে বোঝা নয়। আমরা চাই তারা মানুষের মতো মানুষ হোক। তাদের জীবন সাফল্যের আলোয় আলোকিত হোক।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *