ফুলে-ফলে টইটুম্বুর রাউজানের প্রবাসী রানার ছাদ বাগান

Raozan-Pic-3.10

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরীহাটের পিচঢালা সড়কপথ হয়ে হাজী মীর হোসেন সওদাগর বাড়ির সংযোগ সড়ক।

নিভৃত এই পল্লীর সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে কিছুদূর গেলেই চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজসমৃদ্ধ একটি নতুন দ্বি-তলবিশিষ্ট দালান। প্রধান ফটক অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করতেই আপনার মনে প্রশান্তি এনে দেবে দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির আঙিনার চারপাশের শাকসজ্বির সবুজ দৃশ্য। শুধু সব্জির ফলন নয়, এই বাড়িটিই যেন একফালি সবুজের সমারোহে বেষ্টিত।

ভবনটির চারপাশের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে লাগানো হয়েছে নানান জাতের ফলদ বৃক্ষ। পড়ন্ত বিকেলে বাড়িটির আশপাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কানে ভেসে আসে পাখির কিচির-মিচির শব্দ। বাগানের গাছ আর ফলের সাথেই যেন পাখ-পাখালির গভীর মিতালি জড়িয়ে আছে। গ্রামের নিভৃত এক পল্লীতে স্বপ্নের এই ছাদবাগানটি গড়ে তোলেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী যুবক সরোয়ার রানা।

ছাদ বাগানটি যার হাত ধরেই গড়ে উঠা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী যুবক সরোয়ার রানা ২৪ ঘন্টা ডট নিউজকে বলেন, আঙিনার চারপাশটা দেখলেন ঠিক আছে, চমক আরো বাকী আছে, উপরে উঠলেই বুঝতে পারবেন এদেশে ছাদ কৃষির ছোঁয়া নগর থেকে গ্রামে বিস্তৃত হয়েছে কতখানি!

দ্বিতল ভবনের সিঁড়ি অতিক্রম করে ছাদে উঠতেই সত্যিই অবাক হতেই হলো। তিনহাজার বর্গফুটের এই বাড়িটার বিশাল ছাদজুড়ে টবে লাগানো শতাধিক ফলদ ও ঔষধী বৃক্ষ। স্ট্রবেরি চারায় থোকা থোকা স্ট্রবেরি ঝুলছে, বড় ড্রামে লাগানো আনারস চারায় সরু পাতাগুলি বিকশিত করে দিনদিন বড় হচ্ছে আনারসটি, টবে লাগানো পেস্তাবাদাম গাছে হলদে বর্ণের ফুলে মিষ্টি একটা হাসি যেন ছড়িয়ে আছে বাড়িটির ছাদজুড়ে। এ যেন বৃক্ষমেলার আদলে গড়ো উঠা এক নির্মল পরিবেশ।

উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের হাজী মীর হোসেন সওদাগর বাড়ির হাজী জামাল উদ্দিনের নতুন বাড়ি এটি। এখনো বাড়ির নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এই বাড়ির কর্তা থাকেন শহরে। পরিবারে এক ভাই-তিনবোনের মধ্যে মধ্যে একমাত্র ভাই সরোয়ার রানার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রামের নিভৃত পল্লীর মাঝে দ্বিতল ভবনের বিশাল ছাদজুড়ে গড়ে উঠেছে এই দৃষ্টি নন্দন ছাদবাগান।

ছাদবাগানটির স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক সরোয়ার রানা আলাপকালে ২৪ ঘন্টা ডট নিউজের প্রতিনিধিকে বলেন, ২০০৪ সাল থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী। তবে নিজের ব্যাবসার সুবাদে প্রবাস-আর দেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকেন।

তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি তার নিবিড় একটা টান। তখনকার সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত শাইখ সিরাজের উপস্থাপনা ও পরিকল্পনায় কৃষি বিষয়ক ম্যাগাজিন কৃষি-দিবানিশি, পরবর্তীতে চ্যানেল আই’র পর্দায় হৃদয়ে মাঠি ও মানুষ দেখে ছাদ কৃষির প্রতি তাকে এক অদম্য নেশা পেয়ে বসে। পরবর্তীতে সেই চিন্তা মাথায় সর্বক্ষণ ঘুরপাক খেতো।

২০১৬ সালে এসে তিনি তার স্বপ্নপূরণে কাজ শুরু করেন। নিজের নির্মিত নতুন ভবনের ছাদকেই বেছে নেন ছাদকৃষির জন্য। প্রথমেই ছাদ কৃষি সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা না থাকায় বেশী দামে চারাগাছ কিনে তা অল্পদিনেই পরিচর্যার অভাবে চারা গাছগুলো নষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু ধীরে ধীনে ইন্টারনেটে সময় দিয়ে ছাদ কৃষি সম্পর্কে ধারণা নেন তিনি। এরপর শুরু হয় নব উদ্যোমে পথচলা।

তিনি আরো বলেন, ছাদ বাগান গড়ে তোলার জন্য তিনি দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন জাতের চারাগাছ সংগ্রহ করে সেগুলো নিজের ছাদবাগানে লাগিয়েছেন। ঢাকা জাতীয় বৃক্ষমেলা থেকে শুরু করে পার্বত্য এলাকার চন্দ্রঘোনার রাইখালি, টাঙ্গাইল, হাটহাজারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে তিনি চারাগাছ কিনে এনে তা নিজের বাগানে লাগিয়েছেন।

বর্তমানে এই ছাদ বাগানের জন্য তিনি পাঁচ লক্ষ টাকার অধিক ব্যয় করেছেন। চট্টগ্রাম বাগান পরিবারসহ বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক অনলাইন থেকে পরামর্শ নিয়ে বাগানের পরিচর্যা করেন। বর্তমানে বড়, ছোট এবং মাঝারি সাইজের ড্রাম,টবে লাগানো শতাধিক জাতের চারাগাছ ফুলে-ফলে টইটুম্বুর তার বাগানে।

সরোয়ার রানা আরো বলেন, ছাদবাগানের ফুল আর ফলকে ঘিরে পাখির আনাগোনা বেড়েছে বাড়ির আশপাশে। ছাদবাগানে দাঁড়িয়ে পাখির কিচির-মিচির ডাক শুনে মনটা ভরে যায়। সরোয়ার রানার ছাদ বাগান দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনও ছুটে আসেন। তারা এই ছাদ বাগান দেখে নিজেরাই উৎসাহিত হয়ে তার কাছে ছাদবাগান সৃজন করার বিষয়ে পরামর্শ নেন। এখন তার দেখাদেখি এলাকা ও পাশ্ববর্তী এলাকার অনেকেই বাসা-বাড়ির ছাদে বাগান গড়ে তোলেছেন।

তিনি বলেন, আমি আমার সাধ্যমতো সবাইকে ছাদ বাগানের বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি যাতে করে ছাদ বাগানে সবাই এগিয়ে আসে।

রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে সারোয়ার রানা নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন ছাদবাগান

সরোয়ার রানার গড়ে তোলা ছাদ বাগান ঘুরে দেখা গেছে, তার বাগানে ফলদ গাছের মধ্যে পেঁপে, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা, ভেরিকেটেড পেয়ারা, চায়না পেয়ারা, বারি-২, বারি-৩ পেয়ারা, পলি, মাধবী ও থাই পেয়ারা, আপেল কুল, নারিকেল, ডালিম, পাকিস্তানি কমলা, বেরিকেটেড কমলা,কেকোগাছ, মিষ্টি করমচা, দেশী করমচা, মিষ্টি তেঁতুল,সপেদা, আঁশফল, থাই সরিপা, আলু বুকরা, পেঁপে, থাই জামরুল,কলাগাছ, দেশী জামরুল, গোলাফজাম, থাই জাম্বুরা, জাম, বারমাসি আমড়া, কাঁটাল, আনারস, মিষ্টি কামরাঙ্গা, বারমাসি কামরাঙ্গা, জবটিকা, বারমাসি লেবু, কাগুজে লেবু, ফ্যাশন ফ্রুট, লটকন, থাই কালো জাম, দেশী জাম, আমলকি, মিষ্টি জলপাই, ইকো, মোছাম্বি, বিভিন্ন জাতের আম গাছের মধ্যে ডগমাই, এলপেনসো, ব্রুনাইকিং, হারিভাঙ্গা, সুবর্ণরেখা, বারমাসি, আম্রপালি।

ফুলের মধ্যে বকুল, শেফালি, চম্পা, হাসনাহেনা, গোলাফ, নয়নতারা, গন্ধরাজ, কামিনী, পাতাবাহার, ক্রিসমাস ট্রিসহ আরো বেশ কিছু জাতের ফুলের চারা রয়েছে।

সব্জির মধ্যে টমেটো, ভুট্টা, মরিচ, বেগুন, বিদেশী স্কোয়াশ, থানকুনি, রাইশাখ, বাংলা লাউ, কারিপাতা, পুদিনাপাতা, বাহারপাতা, ঔষধী গাছের মধ্যে স্বর্পগন্ধা, গাইনুরা (ডায়াবেটিকস রোগের জন্য এই গাছটি উপকারী), ক্রুসল, ক্যান্সার গাছ, বাসক, ঘৃতকুমারী, এলোবেরা, উলট কম্বল, চিরতা, তুঁত গাছসহ আরো বেশ কয়েকটি জাতের ঔষধী গাছ রয়েছে।

সরোয়ার রানা বলেন, ছাদ বাগানটি নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। এটিকে দিনদিন কিভাবে আরো বিস্তৃত করা যায় সেটি ভাবনায় আছে তার।

সম্পর্কে সরোয়ার রানা স্কুল জীবনের বন্ধু, বর্তমানে চাঁন্দপুরের হাইমচর থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ আলমগীর ছুটিতে ছুটে এসেছেন বন্ধু সরোয়ার রানার ছাদ বাগান দেখতে।

এ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে তিনিও বলেন, সত্যি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতোনা নিভৃত পল্লীতে শতাধিক জাতের বৃক্ষনিয়ে বড় ছাদ বাগান গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, সরোয়ারের এই ছাদবাগান এলাকার মানুষের মাঝে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। সরোয়ার রানার দেখাদেখি এখন অনেকেই ছাদ বাগান করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

রাউজানে ছাদ বাগান সম্পর্কে জানতে চাইলে রাউজান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন ২৪ ঘন্টা ডট নিউজকে বলেন, নোয়াপাড়া গ্রামে যুবকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ছাদ বাগান গড়ে উঠেছে এটি অবশ্যই ভালো একটি উদ্যোগ। দিনদিন কৃষি জমি যেহারে হ্রাস পাচ্ছে তাতে নিজেদের বাসা-বাড়ির ছাদে সবাই যদি সাধ্যমতো ছাদ বাগান গড়ে তোলে তাহলে শাক-সব্জির চাহিদার অনেকটা যোগান সেখান থেকেই আসবে।

তিনি আরো বলেন, ছাদবাগান আসলেই কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় গ্রামের মানুষের মাঝে এখনো তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। তবে আমরা চেষ্টা করছি, ছাদ বাগান সম্পর্কে মানুষতে উদ্বুদ্ধ করতে। এতে করে একদিকে বিষমুক্ত টাটকা সব্জির যেমন যোগান হবে তেমনি সবুজে ভরে উঠবে আমাদের চারপাশ।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *