করোনায় আক্রান্ত ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়ার আবেগঘন স্ট্যাটাস

২৪ ঘণ্টা ডট নিউজ। জেলা সংবাদ || বিশ্বে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও থেমে নেই। দেশে এখন করোনা হটস্পট নারায়নগঞ্জ।

দেশের মধ্যে এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ। সর্বশেষ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪ শতাধিক।

সরকারি হিসাবমতে এখানে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের। করোনার ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সিভিল সার্জন, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, ম্যাজিস্ট্রেট কেউই। মারা গেছেন ত্রাণ শাখার এক কর্মচারী।

ইতিমধ্যে ১০ চিকিৎসকের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়েছেন জেলা প্রশাসনের তিন ম্যাজিস্ট্রেট, তাদেরই একজন নারায়ণগঞ্জের ই-সেবা কেন্দ্রের সহকারী কমিশনার তানিয়া তাবাসসুম তমা।

বর্তমানে তিনি, তার স্বামী, মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তিনি ছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন আরো দুইজন সহকারী কমিশনার।

নিজের ১ বছরের ছেলে ও ৩ বছরের মেয়েকে ঢাকায় মায়ের কাছে রেখে করোনা মোকাবেলায় কাজ করেছেন। তবুও প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে তাদের নানা সময়।

গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে হোম আইসোলেশনে থাকা এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার ফেসবুক আইডি থেকে কোভিড-১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায়না না অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তার টাইমলাইনে।

স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন ‘ কোভিড ১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন। করোনার ভয়াল থাবা এসে পড়তে দেরী নেই, সবাই প্রস্তুত হও, সরকারের নির্দেশ। সরকারের কর্মচারী তাই পিছপা হবার সুযোগ নেই।

দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধই প্রশাসনের চাকরির ধর্ম। অগত্যা ১ বছরের তাইফ আর ৩ বছরের নামিরাকে মায়ের কাছে ঢাকায় রেখে নারায়ণগঞ্জে থাকতে শুরু করলাম।

নিয়মিত অফিস, মোবাইল কোর্ট, গণসচেতনতা কার্যক্রম, জরুরী ত্রাণ কাজ, কন্ট্রোল রুম ডিউটি, প্রতিদিনের রিপোর্টসহ প্রেস ব্রিফিং তৈরী, বেসরকারি ত্রান সংগ্রহ কার্যক্রম যখন যেটা সামনে পড়েছে করেছি।

ভাবছেন এতো বলছি কেন, এসব তো প্রশাসনের কাজই। হ্যা, সেজন্যই ফটোসেশন, ফেসবুক পোস্ট বাহুল্য এড়িয়ে চলেছি। আমি খুব নিভৃতচারী তাই কাজকে প্রাধান্য দিয়িছি আগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী ছিলাম বলে জীবাণু নিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা রাখি বলে দাবী করি। জীবাণু ভীতিটাও তাই সরিয়ে রেখে কাজ করতে পেরেছি বোধ হয়।

সারাদিনের চেষ্টা ক্লান্তি শেষে যখন দেখতাম লোকজন কথা শুনছে না, একই ব্যক্তি নানা অজুহাতে ঘরের বাইরে আসছে, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে ত্রাণ চাইছে আর প্রশাসনের সকল কাজ নিয়েই, যত দোষ নন্দঘোষ অপপ্রচার তখন শুধু নতুন উদ্যম হাতরে খুজে বেড়াতাম।

কিন্তু খারাপ লাগা ঘিরে ধরত যখন ভিডিও কলে সন্তানের মুখ আর প্রিয় স্বরগুলো শুনতে পেতাম। নিজের চেয়ে বেশি ভাবতাম পরিবারকে নিয়ে। জানেন কতো রাতে ঘুমাতে পারিনি।

শারীরিক মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়েছিলাম। তার মধ্যে সারা দেশে রি রি করে উঠলো প্রশাসন বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন নাকি পিপিই চোর।

অথচ ডিসি স্যার নিজ উদ্যোগে আমাদের সেটা যোগাড় করে দিয়েছিলেন। পরে যতো বেসরকারি পিপিই পাওয়া গিয়েছিলো চিকিৎসকসহ অন্য সবাইকে দেওয়া হয়েছিলো জন স্বার্থে।

যাইহোক নূন্যতম নিরাপত্তাটুকু নিয়েই কাজ চালিয়ে গিয়েছি, সকল প্রশাসন যোদ্ধারাও সারাদেশে তাই করছে। মুসলমান হিসেবে মৃত্যু ভয় মনে রাখিনি, প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রাণ বাঁচাতেই দৌড়ে বেড়িয়েছি।

নিজ জেলা চাঁদপুর, কিন্তু কর্মস্থল দেশের সমৃদ্ধ একটি জেলা নারায়ণগঞ্জকে আজকে যখন লোকে বাংলাদেশের উহান বলছে তখন বুকটা মুচরে উঠে।

আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আজ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারি আক্রান্ত, ত্রাণ কাজের একজন পরিশ্রমী কর্মচারি মৃত্যুবরণ করেছেন।

এখনও মনে পড়ছে শেষ যেদিন সন্ধ্যায় কাশিপুর, গোগনগর এলাকায় মোবাইল কোর্ট করছিলাম মাইকে চিৎকার করে বলছিলাম প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসী, এ জেলার অবস্থা আর কতো খারাপ হলে আপনারা সচেতন হবেন!

আজ আমি, আমার পরিবার (স্বামী, মা), প্রশাসন পরিবার কোভিড ১৯ আক্রান্ত। আমাদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়ার পর আত্মীয়, বন্ধু বিশেষ করে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আল্লাহ যেন দ্রুত আবার সুস্থ্য করে দেন, দেশের সেবা করার তৌফিক দেন।

তাদের সকলের নাম বলতে গেলে তালিখাটি দীর্ঘ হয়ে পোস্টটি আরো বড় হয়ে যাবে।

অসংখ্য ধন্যবাদ সকলকে। ভালো থাকুক নারায়ণগঞ্জ, ভালো থাকুক প্রিয় দেশ। সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।

সাধারণ এ জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত পার করেছি। সন্তান দুটো জন্ম দিতে গিয়ে দু দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন ওদের ভাগ্যে। আবার যেন আমরা প্রিয় মুখগুলোর কাছে ফিরে যেতে পারি, আল্লাহ যেন সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখেন। আমিন।’

২৪ ঘণ্টা/ আর এস পি

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *