চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, লালদিঘীকে না-চিনলে, না-জানলে চট্টগ্রামকে চেনা ও জানা যাবে না। লালদিঘীকে ঘিরেই চট্টগ্রামের ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানান বর্ণিল অধ্যায় সুচিত হয় এবং অনেক বীরত্ব গাঁথার স্মৃতির হীরকখণ্ড এখনো ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে। তাই লালদিঘী শুধু এক টুকরো নৈ:সর্গিক ভূমি নয়, স্মৃতি, সত্তা ও অস্তিত্বের শিকড়।
তিনি আজ শুক্রবার সকালে লালদিঘীর চারপাশ ঘিরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে গড়ে তোলা বাহারী ফুল ও বৃক্ষরাজির সজীব সবুজে শোভিত পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্তকরণ অনুষ্ঠানে এভাবেই এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন।
তিনি লালদিঘী ও তৎসংলগ্ন মাঠের ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপস্থাপন করে বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ নেয়া তরুণ ও যুবকদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি কল্পে আজ থেকে শতবর্ষ আগে আবদুল জব্বার বলী খেলার সূচনা করেন। একে ঘিরেই প্রতি বাংলাবর্ষের ১২ বৈশাখ লালদিঘীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দেশের সর্ববৃহৎ বৈশাখী লোকখেলা হয়ে আসছে। এই লালদিঘীর পূর্বে চট্টগ্রাম, জেল কারাগারে ব্রিটিশ রাজশক্তি অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিল। তারপরের ইতিহাস আরো গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রমনা ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হবার পর দিন লালদিঘী ময়দানে একুশের প্রথম কবিতা মাহবুবু উল আলম চৌধুরীর কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ পাঠ করেছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই লালদিঘীর মাঠে সর্বপ্রথম জনসভায় ৬ দফা ঘোষণা করেন। একাত্তরের অসহযোগের অগ্নিক্ষরা দিলে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটক এই লালদিঘী মাঠে অভিনীত হয় এবং মৌলভী ছৈয়দ আহমদ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে জয়বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্টিত হয়। এটাই ছিলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক মহড়া।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালদিঘী মাঠে জনসভা করতে আসার পথে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টায় সামরিক স্বৈরাশাসকের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে লালদিঘীর অনতিদূরে শহীদ ২৬ জন বাঙালি। এ ধরণের অনেক বীরত্বগাঁথার অনুঙ্কার আছে লালদিঘীকে ঘিরে। তাই চট্টগ্রামের ইতিহাস, রাজনীতি-ধর্ম-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রে লালদিঘীর সম্পৃক্ততা চিরকালীন ও সর্বজনীন তাই চট্টগ্রামকে চেনা ও জানার নাভিমূল বই লালদিঘী।
তিনি আরো বলেন, ১৯৩৯ সালে তৎকালীন কুলীন জমিদার নন্দনকাননের রাজ কুমার ঘোষ তাঁর নিজস্ব জায়গায় লালদিঘীর গোড়াপত্তন করেন এবং লালদিঘীর চারপাশে বাগান করেন। পরবর্তীতে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজ কুমার ঘোষের পরিবার থেকে প্রতীকী মূল্যে লালদিঘী চসিকের মালিকানাধীন করেন এবং দিঘী ও পার্কের নানন্দিক রূপ দেন। তখন এটা হয়ে ওঠে নগরবাসীর প্রাত: ও বৈকালিক ভ্রমণের একটি অতুলনীয় উপাদান। তবে পরে এটা ধীরে ধীরে নান্দনিকতা হারিয়ে ফেলে এবং অসামাজিক কর্মকান্ডের জন্য এর পরিবেশ দুষিত হয়ে ওঠে। মাহিউদ্দিন চৌধুরীর ইচ্ছা ছিলো এই লালদিঘীতে সাধারণ নাগরিকদের সন্তানদের নামমাত্র মূল্যে সাঁতার শেখার জন্য একটি স্যুইমিং পোল করা। তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। তবে ভুল বোঝাবুঝির জন্য কাজটি শেষ করতে পারেন নি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধনী পরিবারের জন্য অভিজাত ক্লাবে স্যুইমিং পোল থাকলেও সাধারণ পরিবারের সন্তানদের জন্য সাঁতার শেখার কোন সুযোগ নেই। আউটার স্টেডিয়ামের একাংশে ক্রীড়া পরিষদ একটি স্যুইমিং স্টেডিয়াম তৈরী করলেও তা অপরিকল্পিত ও নির্মাণগত ত্রুটির কারণে এখন পর্যন্ত ব্যবহার অনুপযোগী। আমি সাধারণ পরিবারের কথা ভেবে তাদের সন্তানরা যাতে এখানে স্বল্প মূল্যে সাঁতার শিখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই।
তিনি জানান, লালদিঘী পারে সিটি কর্পোরেশন লাইব্রেরিটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। এখানে মূল্যবান দুর্লভ গ্রন্থের সংগ্রহ রয়েছে। জাইকার অর্থায়নে এই লাইব্রেরি ৮ম তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এটাকে মানব সম্পদ গঠনের উপযোগী করে তুলে ডিসেম্বররের মাঝামাঝি সময়ে উদ্বোধন করার চিন্তা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, লালদিঘীর পারে চারপাশ দিয়ে প্রাত: ও বৈকালিক ভ্রমণকারীদের ¯^চ্ছন্ধে হাঁটাহাটির জন্য ওয়াকওয়ে করে দেয়া হয়েছে। নানান উপাদানে পার্কটি নানন্দনিক করা হয়েছে। এখন সকাল ৬ টা থেকে ৮ টা এবং বিকেল ৩ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। লালদিঘীর চারপাশে মিউজিক্যাল লাইটিংয়ের মাধ্যমে আলো ও সুরের মুর্চ্ছনা ইভেন্ট যুক্ত করা হবে। খাবার সামগ্রীর প্যাকেট নিয়ে এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যত্রতত্র ভাবেকোন বর্জ্য ফেলা যাবে না।
তিনি নগরবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, লালদিঘী মানবিক নগরতৈরীর একটি আবশ্যিক উপাদান। লালদিঘী কংক্রিটের ঝঞ্জালে ¯^চ্ছ জল, বাহারী ফুল ও সুবুজের এক টুকরো ভূ-¯^র্গ ভূমি এর প্রতি সমতা ভরা সংবেদনশীলতা সৌন্দর্য্য ও পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব নগরবাসীর আর চসিকের দায়িত্ব নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষনের। ঐ সময় পার্কে প্রাত: ভ্রমণে আসা লোকজনকে চসিকের চিকিৎসক ও ¯^াস্থ্যকর্মীরা ডায়বেটিক, রক্তের উচ্চচাপ পরীক্ষাসহ বিনামূল্যে ¯^াস্থ্যসেবা প্রদান করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চসিক প্রশাসকের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম, নির্বাহী প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম, বিপ্লব কুমার দাশ, ডা. অঞ্জন কুমার দাশ, অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরমেদুল আলম চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, আবুল মনসুর, মাহবুবুল হক সুমন, কাউন্সিলা প্রার্থী নোমান লিটন, পুলক খাস্তগীর, আব্দুস সালাম মাসুম, মহিউদ্দিন শাহ, রুমকি সেনগুপ্ত, কামরুল হক, জানে আলম, সোলায়মান সুমন প্রমুখ।
এছাড়াও চসিক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন লালদিঘী থেকে ফেরার পথে নিউমার্কেট ও স্টেশন রোড রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে আবর্জনা দেখতে পান।
তিনি গাড়ি থেকে নেমে এই আবর্জনাগুলো দোকান মালিকদের দিয়ে অপসারণ করেন এবং এখন থেকে দোকানের সামনে কোন আবর্জনা ফেলা হলে তাদেরকেই সেই আবর্জনা পরিস্কার করতে হবে বলে সর্তক করে দেন।
২৪ ঘণ্টা/রিহাম
Leave a Reply