বিনোদন স্পেশাল : চারিদিকে সবুজের সমারোহ। যেখানে সোনালি আলোর অপরূপ আয়োজন। বাংলার আনন্দমীয় পল্লী প্রকৃতি যেন দিকে দিকে গাঢ় সবুজ রঙের পিকচারি নিয়ে মনের আনন্দে হোলি খেলছে। আকাশ সাদা নির্মল। তেমনি একটা জায়গা খাগড়াছড়ি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ নিকেতন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। চেঙ্গী উপত্যকার জেলাটি পাহাড় বেষ্টিত হলেও প্রায় সমতল ভূমির উপর গড়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি জেলা শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে আর রহস্যময়তায় ঘেরা খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলা প্রকৃতপ্রেমী, এডভেঞ্চার প্রিয় ও ভ্রমনাবিলাসীদের জন্য আদর্শ স্থান। তাই খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পর্যটন স্পট এক নজরে।
আলুটিলা :
ঐশর্যময় সৌন্দর্য্যরে অহঙ্কার খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ পথেই চোখে পড়বে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র। খাগড়াছড়ি জেলার পুরাটাই পাহাড়ি এলাকা। এর মধ্যে মাটিরাঙ্গা আলুটিলা পাহাড়ে সৌন্দর্য্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যতদূর দেখা যায় শুধু পাহাড় তার পাহাড়।
এর নাম আলুটিলা হলেও কোনো আলু কিন্তু পাওয়া যায় না এই পাহাড়ে। তবে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে ব্যাপক দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন কোথাও খাবার পাওয়া যায়নি। এই সময় এই পাহাড়ে অনেক আলু হয়েছিল।
দূর্ভিক্ষের সময় আদিবাসীরা আলু খেয়ে বেঁচে ছিল। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম আলুটিলা। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে ঢোকার প্রধান ফটকের দুই পাশে শতবর্ষী দুটি বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৮ কি.কি. পশ্চিমে আলুটিলা পাহাড় চুড়ায় আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন কেন্দ্রটি খাগড়াছড়ি চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত হওয়ায় বাস, টেক্সিযোগে যাতায়াত করা যায়।
রহস্যময় সুড়ঙ্গ :
স্থানীয় লোকের ভাষায় ‘মাতাই হাকর’ যার বাংলা অর্থ দেবগুহা, এ পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ির নীচে আনুটিলা পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাজে গড়া এ রহস্যময় সুড়ঙ্গের অবস্থান।
গুহামুখের ব্যাস প্রায় ১৩ ফুট আর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮০ফুট, প্রবেশ মুখ ও শেষের অংশ আলো আধারিত আছন্ন। মাঝখানে নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকার এ গুহার তলদেশ দিয়ে প্রবাহমান শীতলজলের ঝর্ণাধারা, এ গুহায় প্রবেশ করাটা একদিকে যেমন ভয় সংকুল তেমনি রোমাঞ্জকরও বটে।
শুধু বাংলাদেশতো বটেই পৃথিবীর অন্য কোন দেশেও এ রকম প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ পথের খুব একটা নজির নেই। অনন্য সাধারণ এ গুহার মশাল বা উজ্জ্বল টর্চের আলো ব্যতীত প্রবেশ করা যায় না।
মশাল পর্যটন কেন্দ্রেই পাওয়া যায় ১০ টাকার বিনিময়ে। গুহার একদিকে ঢুকে অন্যদিকে বেরোতে সময় লাগে একমাত্র ১০/১১ মিনিট।
ধাতুচৈত্য বৌদ্ধবিহার :
আনুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের কয়েক শতগজ সামনেই এই বৌদ্ধ মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের নাম আলোক নবগ্রহ ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার। স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন এই মন্দির।
এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষন হল পদ্মাসনে বসা বুদ্ধের একটি শিল্প মূর্তিসহ বিভিন্ন অবয়বে বেশ কয়েকটি মূর্তি। প্রতিবছর এখানে কঠিন চীবর অনুষ্ঠান অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় যা পর্যটকদের নিকট অতি আকর্ষনীয়।
হেরিটেজ পার্ক :
খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলা শহরের প্রবেশ মুখে প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে একটি নৈসর্গিক হেরিটেজ পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। যা দেখতে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের ভিড় পড়ছে।
চেঙ্গী নদীর পার ঘেষে জেলার আনসার এ ডিভিপি প্রশিক্ষন কেন্দ্রের উচুঁ পাহাড়ে অবস্থিত হেরিটেজ পার্ক। পাহাড় ঘেরা এ প্রকৃতিতে বসে চাঁদনী রাতে দৃশ্যপট অবলোকন করা যায়।
দেবতা পুকুর দেবতার লেক :
সদর উপজেলার নুনছড়ি মৌজায় আনুটিলা পর্বত শ্রেণী হতে সৃষ্ট ছড়া নুনছড়ি। নুনছড়ি ছড়ার ক্ষীন স্রোতের মধ্যে রয়েছে প্রকান্ড সব পাথর। সুমদ্র সমতল হতে প্রায় ১০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় দেবতা পুকুর রূপকথার দেবতার আর্শীবাদের মতো সলিল বারির স্রোতহীন সঞ্চার।
এত উচুঁ পাহাড় চূড়ায় পুকুরটি নানা রহসে ভরপুর। এ পুকুর ত্রিপুরাদের তীর্থক্ষেত্র। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি এখানে তীর্থক্ষেত্র বসে এবং তান্ত্রিক বিধানমতে ত্রিপুরাগণ যাগযজ্ঞাদি করে।
ত্রিপুরাদের ভাষায় দেবতার পুকুরের নাম মাতাই পুখিরী মাতাই অর্থ ‘দেবতা’ আর পুখির অর্থ ‘পুকুর’ কথিত আছে স্থানীয় মন্দিরের জল তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল দেবতা স্বয়ং এ পুকুর খনন করেন।
পুকুরের পানিকে স্থানীয় লোকজন দেবতার আর্শীবাদ বলে মনে করেন। প্রচলিত আছে যে, এ পুকুরের পানি কখনো কমে না। আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, এই পুকুর কোন দেবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পুকুরের তলায় বহু গুপ্তধন লুকায়িত আছে যা দেবতারা পাহারা দিচ্ছে।
অনেকের ধারনা এখানে এসে গোসল করলে বা কিছু চাইলে তা পুরণ হয়। এই এলাকাটি ত্রিপুরা অধ্যুষিত।
খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি সড়কে জেলা সদর থেকে ১১ কি.মি. দক্ষিণে মূল রাস্তা হতে ৪ কি.মি. পশ্চিমে সদর উপজেলার নুনছড়ি মৌজায় চির প্রশান্তিময় দেবতা পুকুরের অবস্থান।
জেলা সদর হতে মাইসছড়ি পর্যন্ত বাসে যাতায়াত করা যায়। মাইসছড়ি হতে নুনছড়ি ছড়া পর্যন্ত হেরিংবোন রাস্তা আছে। চান্দের গাড়ি, জীপ গাড়ি বা পায়ে হেঁটে ঝর্ণামুখ নুনছড়ি থেকে প্রায় ১ কি.মি. পায়ে বেয়ে পাহাড়ের শীর্ষে দেবতার পুকুর।
রিছাং ঝর্ণা :
আনুটিলা পর্যটন স্পট থেকে প্রায় ৩কি.মি. পশ্চিমে (খাগড়াছড়ি থেকে ১১ কি.মি.) খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা সড়ক হতে বাম পার্শ্বে ১ কি.মি. দক্ষিণে রিছাং ঝর্ণা অবস্থিত।
জেলা সদর থেকে আনুটিলা পেরিয়ে সামান্য পশ্চিমে মূল রাস্তা থেকে উত্তরে ঝর্ণা স্থানের দূরত্ব সাকুল্যে প্রায় ১১ কি.মি. ঝর্ণার সমগ্র যাত্রা পথটাই দারুন রোমাঞ্জকর।
বাদল বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে বোরা প্রকৃতির চোখে জল কেবল পড়েই যাচ্ছে। ঝর্নার অবিরাম শব্দ যেন বোবা প্রকৃতির বহুদিনের সঙ্গীত মুখর তাব্য ও ভাষা। নয়ানিভরাম সৌন্দর্য্যরে আধার এই রিছাং ঝর্ণা।
মহাসড়ক হতে হেরিংবোন রাস্তায় জীপ প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বা পায়ে হেঁেট যাতায়াত করা যায়। ২৫-৩০ হাত উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে ঝর্নার জলরাশি। ঢালু পাহাড় গড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে এই প্রবাহ।
প্রতিদিন বহু সংখ্যক পর্যটক এখানে এসে ভীড় জমান এবং ঝর্ণার শীতল পানিতে গা ভিজান। মারমা ভাষায় এর নাম রিছাং ‘রি’ শব্দের অর্থ পানি, আর ‘ছাং’ শব্দের অর্থের গড়িয়ে পড়া।
শান্তিপুর অরন্য কুটির : খাগড়াছড়ি জেলার অন্যতম সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকা পানছড়ি উপজেলা। এ উপজেলার শান্তিপুর নামক স্থানে ১৯৯৯ সনে শান্তিপুর অরন্য কুটির স্থাপিত হয়েছিল, বিশাল এলাকাজুড়ে অরন্যে আবৃত বলেই হয়তো এর নামকরণ হয়েছে অরন্য কুটির। এ
টি মূলত বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরে প্রধান আকর্ষণ হল এখানেই বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তিটি রয়েছে। যার উচ্চতা ৪৮ ফুট। প্রতিদিন বহু পর্যটক মূর্তিটি দেখতে ভিড় জমান এই কুটিরে।
এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এটি একদিকে তীর্থস্থান এবং অন্যদিকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে, শান্তিপুর অরন্য কুটিরে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে সাড়ে ৪৮ফুট উচ্চতার গৌতম বুদ্ধের মূর্তি লাভীশ্রেষ্ঠ সিবলী মহাস্থবিরের মন্দিরসহ মূর্তি, মার বিজয়ী উপগুপ্ত মহাস্থবিরের মূর্তি, অধ্যক্ষ মহোদয়ের আবাসস্থল মৈত্রীভবন, ১০০ হাত দৈর্ঘ্যরে ভিক্ষুশালা, ৬০ হাত দৈর্ঘ্যরে দেশ নাঘর, ৮০ হাত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ভোজন শালা এবং বড় বুদ্ধ মূর্তির ছাত্র।
দুদক ছড়াং, পানছড়ি ঐতিহাসিক পাবর্ত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির অস্ত্র সমার্পন স্থল :
খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের দুদকছড়া নামক স্থানে ঐতিহাসিক পাবর্ত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল, বিভিন্ন পর্যায়ে শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে সংলাপ ছাড়াও শান্তিবাহিনী কর্তৃক দ্বিতীয় দফা অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠান এখানেই করা হয়েছিল।
খাগড়াছড়ি জেলা শহর হতে খাগড়াছড়ি পানছড়ি সড়ক দিয়ে ২৬ কি.মি. পথ অতিক্রম করলেই দেখতে পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির স্মৃতিস্তম্ভ বিজড়িত এ স্থানটি।
রামগড় পর্যটন এলাকা : খাগড়াছড়ি জেলা সদর হতে ৫০ কি.মি. উত্তর পশ্চিমে রামগড় উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সম্মুখভাগে অবস্থিত। রামগড় উপজেলা চত্বরের সামনে অবস্থিত প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা এ হ্রদটির আকৃতি অনেকটা ইংরেজী অক্ষর ড এর অনুরুপ।
এতে আনন্দ ভ্রমনের জন্য রয়েছে পথ দ্বারা চালিত ছোট বড় বেশ কয়েকটি প্রমোদ তার। রামগড় পর্যটন লেকটি অত্যন্ত আর্কষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। লেকে রয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বোট এবং লেকের পাড়ে সুন্দর বাগান, সবুজ খাস, আধুনিক লাইটিং, বাধানো সিঁড়ি এবং পর্যটকদের বসার জন্য সুব্যবস্থা।
পর্যটকদের জন্য গাড়ি পার্কিং রান্নার সুব্যবস্থাসহ পিকনিকের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা এখানে রয়েছে। রামগড় লেকের দুই তীরে রয়েছে মনোমুগ্ধকর উদ্যান। উদ্যানে দেশি বিদেশী বিভিন্ন ধরনের শোভাবর্ধনকারী ও ঔষধি গাছপালা রয়েছে।
এ উদ্যানে আগত দর্শকদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে প্রায় ১২ (বার) টি শেড। নৌকায় অবতরণের জন্য দুইটি সিঁড়ি সহ নৌকা ঘাট।
ঝুলন্ত ব্রীজ : রামগড় লেকের ঠিক মধ্যখানে একটি ঝুলন্ত ব্রীজ রয়েছে। এটি কেবল জনসাধারণের চলাচলের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকে। তবে যান চলাচল নিষিদ্ধ। ব্রীজের এক মাথায় যে দুটি পিলার থেকে ঝুলন্ত ব্রীজের তার টানানো হয়েছে তা দেখতে ইংরেজী সংখ্যা ‘ওও’ এর মত।
যেতে হবে যেভাবে : চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যেতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা। বাস ভাড়া লাগবে ১৭০ টাকা, ঢাকা থেকে সময় লাগবে সরাসরি বাস এ ৬ ঘন্টা। বাস ভাড়া লাগবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
২৪ ঘণ্টা/রাজীব
Leave a Reply