রাউজানের স্কুলছাত্রী অভিমানী রুনার এ ঘুম আর ভাঙবেইনা !

হালকা-পাতলা গঠনের মেয়েটিকে ঘিরে নিম্নবিত্ত পরিবারটির ছিল আকাশ সমান স্বপ্ন। পরিবারে অভাব-অনটান লেগে থাকলেও মেয়ের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নটা ঠিকই আশার বেলুন হয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে আব্দুল মন্নানের পরিবারে। মেয়েটি একদিন কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে সমাজে পরিবারের মুখ উজ্জল করবে আরো কত্তো রঙিন স্বপ্ন উঁকি দিত চিকদাইর মাওলানা বদিউর রহমান বাড়ির ঝরাজীর্ণ এক কুটিরে।

না, মেয়েকে নিয়ে বাবা-মা’র সেই স্বপ্ন আর কোনোদিন পূরণ হবেনা। অনেকটা বুকভরা অভিমান নিয়ে পরিবারের আদুরে মেয়েটি চোখ দুটো যে বন্ধ করলেন চিরদিনের জন্য সেই চোখজোড়া আর কখনো আলোর মুখ দেখবেনা।

বাবা-মা, পরিবারের স্বজনদের চোখের জলে ভাসিয়ে বুধবার সকালে স্কুল ছাত্রী রুনা আকতার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বুকের মানিকধনকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় মা নয়ন বেগম।
নিজের চোখের কাছে মেয়ের ব্যাথাতুর ছয়মাসের যে দৃশ্যপট তা কিন্তু কোনোদিন ভুলতে পারবেন রুনা আকতারের মা! তাইতো তার বুকফাঁটা আহাজারিতে শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ির আশপাশে।

গতকাল বুধবার সকালে চিকদাইর শাহাদাৎ ফজল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্রী রুনা আকতারের মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন থাকায় রুনা আকতারের লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে রাউজান থানা পুলিশ।

ময়না তদন্ত শেষে তার লাশবাহী গাড়ি যখন রাত আটটার দিকে বাড়িতে প্রবেশ করে তখন শেষবারের মতো মেয়েটিকে দেখার জন্য অসংখ্য মানুষ ছুটে আসে তার বাড়িতে। তখন বাড়িজুড়েই কান্নার রোল। রাত এগারটার দিকে নামাজে জানাজা শেষে তাকে এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলছাত্রী রুনা আকতারের সাথে প্রতিবেশী রুবেলের আত্মীয় পটিয়া শিকলবাহা জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যান বাড়ির কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম অভির সাথে তার প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল। গত ৩ এপ্রিল চিকদাইওে নেওয়াজ গাজীর ওরশ উপলক্ষে মেলায় অভির সাথে ঘুরতে যান রুনা। বিষয়টি এলাকার কিছু যুবকের দৃষ্টিগোচর হলে টের পেয়ে মেলা থেকে সটকে যান অভি। এ সময় মেলায় প্রতিবেশী নুরুল আমিনের ছেলে মঞ্জুর হোসেন (২২), কবির আহম্মদের ছেলে কফিল উদ্দিন (২০) মো. বশিরের ছেলে হেলাল (২০) ফয়েজ আলীর ছেলে বেলাল (১৯) সহ অজ্ঞাতনামারা উত্তক্ত্য করেন বলে তার পরিবারের সদস্যদের জানান। মেলার আশপাশে একটি বোরকা পরা মেয়েকে বিচলিতভাবে ঘুরতে দেখে চিকদাইর শাহাদাদ ফজল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাকের হোসেন মাস্টার মেয়েটিকে কাছে ডেকে পরিচয় শনাক্ত করে তার পরিবারের স্বজনদের খবর দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেন। বিষয়টি নিয়ে রুনা আকতারকে তার পিতা প্রচন্ড বকাঝকা করেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে রুনা আকতার গোয়ালঘরে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাকালে তাকে সেখান থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এরিমধ্যে এলাকার কয়েকজন যুবকের নাম উল্লেখ করে মেয়েকে উক্ত্যক্ত করার ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন স্কুল ছাত্রী রুনার বাবা আব্দুল মন্নান। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। আরিফুল ইসলাম অভিকে মামলায় সাক্ষী করে আসামি বেলালকে অব্যাহতি দিয়ে করা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রামের সাব ইন্সপেক্টর মো. কামাল আব্বাস মামলাটি তদন্ত করে ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে রুনা আকতারকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় প্রতিবেশী নুরুল আমিনের ছেলে মঞ্জুর হোসেন (২২), কবির আহম্মদের ছেলে কফিল উদ্দিন(২০) বাশির উদ্দিনের ছেলে হেলাল ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে চমেকের নিউরো সার্জারি বিভাগে ৯ মে পর্যন্ত ১ মাস ১৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর রুনাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলে মুমুর্ষ অবস্থায় দীর্ঘ ছয়মাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকা মেয়েটি গতকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *