ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জ; বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, বন্ধ হতে পারে বিদ্যুৎ সরবরাহ

সিলেট প্রতিনিধিঃ টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ বন্যায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জ। ইতিমধ্যে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের উদ্ধারে কাজ করেছে সেনাবাহিনী। দুই জেলার ৮ উপজেলায় সেনাবাহিনীর ৯ টি ইউনিট কাজ করছে।

শুক্রবার দুপুর থেকে নৌকা দিয়ে প্লাবিত এলাকার বাড়িঘর থেকে পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছেন সেনাবাহিনী সদস্যরা।

বন্যার পানি সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রবেশ করায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। পানি বাড়লে বন্ধ হয়ে যাবে সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ। তবে কুমারগাঁও বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্র রক্ষা করতে কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দুপুর ১২টার দিকে গ্রিড উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ বন্ধ করতে জিও ব্যাগ ফেলা হয়।

সিলেট-সুনামগঞ্জের কোথায় কোথায় ঘরে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি ওঠায় অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন, সেই সাথে পাচ্ছেন না খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানিও। তৈরি হয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়, বন্যার পানি যত বাড়ছে-সংকটও তত বাড়ছে। এখনও সিলেটের প্রধান নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনী বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পানিবন্দী মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও বন্যা আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান। স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সীমিত পরিসরে খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করছেন।

সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক গণমাধ্যমকে জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সিলেটের ৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় সেনাবাহিনী পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার সহ পাঁচটি কাজে তৎপরতা শুরু করেছে। সিলেটের উপজেলাগুলো হচ্ছে সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলার সদর, দিরাই, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ।

তিনি জানান, সিলেট কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানি ওঠে বিদ্যুৎ সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি খাদ্য গুদাম হুমকিতে রয়েছে। এগুলো রক্ষায়ও সেনা সদস্যরা কাজ করছেন। সেনাবাহিনী নিজস্ব নৌকা দিয়ে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করছে। ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে আরও ‘রেসকিউ বোট’ আনা হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় লোকজনের নৌকাগুলোও উদ্ধার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের কাজ করতে পারাকে সেনাবাহিনী গৌরবের মনে করে বলেও মন্তব্য করেন।

এদিকে বিভিন্ন উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বন্যার্ত মানুষদের ভিড় বেড়েছে। কোথায় কোথায় আবার আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা সংকট রয়েছে। এছাড়াও দুই জেলার বেশিরভাগ স্থানে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। সুরমা নদীর পানি উপচে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেড়েছে নগরের পানিবন্ধী মানুষের দুর্ভোগও। নগরে দুর্গন্ধযুক্ত পানির মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও মানুষজন। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন প্লাবিত এলাকার বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জের লাখ-লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। সুনামগঞ্জ জেলার সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বৃহস্পতিবার রাত থেকে। এদিকে টানা বৃষ্টি ও পানির ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট জেলা শহরের সাথে সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পানি।

সুনামগঞ্জ জেলার পৌরশহর, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর, মধ্যনগরসহ আরও নতুন উপজেলার নতুন নুতন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী আছেন কয়েক লাখ-লাখ মানুষ। সুনামগঞ্জে বন্ধ আছে সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এর আগে গত ১৫ মে থেকে সিলেট নগর ও ১৩টি উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছিল। এতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।

শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে সিলেট নগরের সোবহানীঘাট, যতরপুর, উপশহর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, সাদাটিকর, তেরোরতন, মাছিমপুর, কদমতলি, ছড়ারপাড়, কালীঘাট ও তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, লামাপাড়, বেতেরবাজার, ঘাসিটুলা, বাগবাড়ি, শেখঘাট, টিকরপাড়া, কুয়ারপার, কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি দেখা গেছে।

এসময় নগরের যতরপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, ঘরের ভেতরে ও চারপাশে পানি থাকায় বন্দী হয়ে আছি, ৩দিন ধরে এ অবস্থায় রয়েছি। প্রতিদিন পানি বাড়ছে, ফলে বাসার অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়াতে ভোগান্তির শেষ নাই আমাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল ৬টার তথ্য অনুযায়ী- সুরমা নদীর দুটি ও কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সারি নদের একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে বলে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্যাকবলিত মানুষেরা জানিয়েছেন, সিলেট নগরের অন্তত ২০টি এলাকার পাশাপাশি জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সদর, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ছয় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। চলাচলের জন্য মিলছে না নৌকা। ফলে জরুরি প্রয়োজনে কেউ ঘরের বাইরে বেরোতে পারছেন না।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুপুর ১২টা থেকে জিও ব্যাগ ফেলে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছেন। তবে কতক্ষণ প্রতিরোধ করা যাবে তা বলা যাচ্ছে না। পানি আরো বাড়লে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *