মেসি-জাদু নাকি মদরিচ-মায়া

বিশ্বকাপ ফুটবল। কাঁদায়। হাসায়। হৃদয় রক্তাক্ত করে। একরাশ শূন্যতার জন্ম দেয়। আবার মুহূর্তের নাটকীয়তায় আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। কাতারে মরুর বুকে ফুটবলের মহামেলায় তার ব্যতিক্রম কিছু কি দেখছে ফুটবল বিশ্ব।

গারিঞ্চাকে মনে করিয়ে দেওয়া কি অসাধারণ ড্রিবলে নেইমারের গোল! তারপরই ব্রাজিলের স্বপ্ন শেষ করে দিল লুকা মদরিচের ক্রোয়েশিয়া। চোখের জলে বিদায় নেইমারের। মরক্কো আরব্য রজনীর গল্প লিখল আর কাঁদতে কাঁদতে টানেল দিয়ে হারিয়ে গেলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। হয়তো বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে চিরদিনের জন্য তার চলে যাওয়া। কাতারে আপনি আর দেখবেন না, পাখির মতো শূন্যে উঠে রোনালদোর হেড। দেখবেন না গারিঞ্চাকে মনে করানো নেইমারের ড্রিবল! ফুটবলপ্রেমীদের আবেগের বলয়ে পড়ে রইল কী! লিওনেল মেসির বাঁ পায়ের জাদু। আর এমবাপ্পের চিতার মতো দৌড়।

মেসির জাদু শেষ হয়ে যেতে পারে আজ রাতে লুকা মদরিচ-মায়ায় ক্রোয়েশিয়ার কাছে। আর ফুটবল বিশ্বে আরব বসন্তের বার্তা দেওয়া মরক্কো থামিয়ে দিতে পারে কাল এমবাপ্পের দৌড়! তেমন কিছু হলে আর্জেন্টিনার পারস্য অভিযান শেষ, বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেই। আজ যদি ফুটবল মদরিচ-মায়ায় মুগ্ধ হয়ে পড়ে তাহলে এবারের বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার কাছে মরুভূমিতে মরীচিকাই মনে হবে। আর্জেন্টিনাকে ঘিরে এখন ল্যাটিন ফুটবল সৌন্দর্যের যে আবেগের বলয়, সেখানে থাকবে শুধু নীরব নিস্তব্ধতা। শোকের ছায়া। নেইমার, রোনালদোর বিদায়ের পর মেসি আজ বিদায় নিলে, বারবার বলা হবে, ভাঙাগড়ার বিশ্বকাপ। হাসিকান্নার বিশ্বকাপ। স্বপ্নভঙ্গের বিশ্বকাপ! হয়তো বলা হবে, চমকের বিশ্বকাপ!

মেসি বিদায় নিলে কাতার বিশ্বকাপে নায়ক কে হবেন, বলা যাচ্ছে না। তবে নেইমার, রোনালদোর পর মেসির নামও যদি যুক্ত হয় ট্র্যাজিক হিরোদের তালিকায়, তাহলে কাকে নিয়ে লেখা হবে ফুটবলের নতুন আরব্য রজনী? তখন লেখা হবে সেই পুরোনো কথাটা আবার নতুন করে। ফুটবল বিশ্বকাপ রাজাকে ফকির বানায়। ফকিরকে রাজা! কাতার বিশ্বকাপ নতুন কোনো চমক দেখাতে যাচ্ছে কি না, তার খানিকটা আভাস মিলতে পারে আজ। চিরতরে টানেলে হারিয়ে যাওয়ার আগে বাজিমাত করে বাজিগর হওয়ার সুযোগ আছে এখনো লিওনেল মেসির।

লিওনেল মেসি—এলএম টেন।এই গ্রহে আবেগ বলুন, আর ফুটবল লড়াই বলুন, মেসির শ্রেষ্ঠত্বকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফলেছেন যিনি, সেই রোনালদো বিশ্বকাপ মঞ্চে নেই। আজ সেমিফাইনালে এলএম টেনকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন আরেক এলএম টেন! হ্যাঁ, ঠিকই লেখা হয়েছে। এবং আপনি ঠিকই পড়ছেন। আজ সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা বনাম ক্রোয়েশিয়া লড়াইয়ের মাঝে আরেক লড়াই। সেটা এলএম টেন বনাম এলএম টেন! লিওনেল মেসির সঙ্গে লড়াইটা লুকা মদরিচের। দু‍‍জনেই ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। দুজনই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। দু‍‍জন নিজের দেশকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন। কিন্তু দু‍‍জনের কারোরই বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখা হয়নি! তবে লিওকে ঘিরে আবেগের অন্য রকম আভা। এখানে খানিকটা পিছিয়ে লুকা।
তারপর মধ্য ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া এই দুই তারকাকে আটকানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুই দলের কোচ। যদিও তারা জানেন লিও বা লুকাদের আটকানোর ফর্মুলা বের করা কঠিন। ক্রোয়েট কোচ তো বলেই ফেলেছেন, ‍‍“মেসি নয়। আমার পরিকল্পনা আর্জেন্টিনাকে নিয়ে।‍‍” আর আর্জেন্টাইন কোচের মন্তব্য অনেক বেশি টেকনিক্যালি ইতিবাচক। ক্রোয়েশিয়ার যা খেলার ধরন, তারা প্রতি-আক্রমণনির্ভর ফুটবল খেলে তারা ম্যাচটা নিয়ে যেতে চাইবে টাইব্রেকার পর্যন্ত। সে কারণেই আর্জেন্টাইন কোচ বলেছেন, ‍“আমরা ৯০ মিনিটেই খেলা শেষ করতে চাই। এবং সেটা ১২০ গজে।‍‍”

যার দলে একজন মেসি আছেন, যার একটা ম্যাজিক্যাল পাস বা টাচ ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে, তার কোচ কেন ভাববেন টাইব্রেকারের কথা! তার পোস্টে যতই মার্টিনেজ নামক একজন গোলকিপার থাকুন। তিনি পেনাল্টি শুট-আউটে যতই ডাচদের প্রথম দুটো শট আটকে দিয়ে আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে তুলে আনুন না কেন। ম্যাচের আগে আবেগের সীমান্তে লিওনেল মেসি আর লুকা মদরিচ একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে নেই। ফুটবলের মহোৎসবে মেসি আর আর্জেন্টিনাকে ঘিরে আবেগটা একটু বেশি। মেসির সঙ্গে মদরিচের তুলনা হচ্ছে তার কারণ খেলাটা ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে। কিন্তু লিওনেল মেসিকে বিশ্বকাপ এলেই লড়াই করতে হয় আরেকজনের ছায়ার সঙ্গে। তিনিও ১০ নম্বর জার্সি পরতেন। এবং ওই আকাশি-সাদা জার্সি। তার নামেরও প্রথম অক্ষর ‍‍‘ম‍‍’! অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। অসাধারণ ফুটবল খেলে ছিয়াশিতে প্রায় একার সৃষ্টিশীল দক্ষতায় আর্জেন্টিনাকে কাপ জিতিয়েছিলেন। ম্যারাডোনা পারলে আপনি কেন কাপ এনে দিতে পারবেন না মেসি! তাহলে আপনি কিসের সেরা! এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে ক্যারিয়ারের প্রান্তে লিওনেল মেসি। আর মাত্র দুটো ম্যাচ জিতলেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কাপ হাতে প্রান্তিক স্টেশনে নামতে পারবেন তিনি। এই পঁয়ত্রিশেও তার মধ্যে স্বপ্ন নিয়ে ছুটে চলার ফুয়েল আছে। ডাচদের বিপক্ষে ‍‍‘ব্যাটেল অব লুসাইলে‍‍’ কাপ জয়ে মরিয়া আগ্রাসী এবং স্পর্ধা দেখানো অন্য রকম এক মেসিকেই দেখল ফুটবল বিশ্ব। স্নায়ুচাপে ভুগতে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকরা এই মেসিকেই দেখতে চান।

অন্যদিকে ব্রাজিলকে বিদায় করে সেমিফাইনালে আসা মদরিচকে লড়াই করতে হয় নিজের সঙ্গে। সাঁইত্রিশে পৌঁছে যে লড়াইটা তিনি করছেন, সেটা অবিশ্বাস্য। অসাধারণ। এখন দরকার অবিস্মরণীয় দুটো জয়। তাহলে পেলে-ম্যারাডোনার পাশে না রাখলেও পাওলো রসি, জিনেদিন জিদানদের সঙ্গে মদরিচের নামটা ফুটবল বিশ্বকে উচ্চারণ করতেই হবে।

মেসি-জাদু, নাকি মদরিচ-মায়ায় আচ্ছন্ন হবে ফুটবল বিশ্ব! উত্তরের জন্য অপেক্ষা তো আর কিছু সময়ের।

লেখক:অঘোর মণ্ডল, ক্রীড়া সাংবাদিক

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *