চন্দ্র প্রথম মাস ‘মহররম’। এ মাসের দশম তারিখকে ইসলামের পরিভাষায় ‘আশুরা’ বলা হয়। এই দিনে একদিকে যেমন রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত, অন্যদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আর তাই এ দিনটি নানা কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
মহান আল্লাহ তাআলার কাছে বছরের বেশ কিছু দিন মাস ও মুহূর্ত বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন। এসবের মধ্যে হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ ইয়াওমে আশুরাও একটি। এই আশুরা শব্দটি আরবি। এটি অর্থ দশম। শব্দটি হিজরি বর্ষের ১০ তারিখকে বুঝায়। হিজরি বছরের হিসেব মতে আগামী ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে আশুরার শুভক্ষণ। যা শুক্রবার সন্ধ্যা তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
আশুরার তাৎপর্যপূর্ণ ফজিলত
ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে অনন্য আশুরা। আশুরার অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ফজিলত আছে। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
০১.এক বছরের গুণাহ মাফের সুযোগঃ-
রাসূল (সা)-এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণী—
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ” رواه مسلم 1162.
অর্থাৎ,আমি আল্লাহর নিকট প্রতিদান প্রত্যাশা করছি, আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে।”[সহিহ মুসলিম]
০২. আশুরার রোজার ব্যাপারে রাসূল (সা) এর আগ্রহঃ
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ : مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلا هَذَا الْيَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ . ” رواه البخاري 1867.
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “ফজিলতপূর্ণ দিন হিসেবে আশুরার রোজা ও এ মাসের রোজা অর্থাৎ রমজানের রোজার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যত বেশি আগ্রহী দেখেছি অন্য রোজার ব্যাপারে তদ্রূপ দেখিনি।”[সহিহ বুখারি]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ ” . أخرجهُ مسلمٌ (1163) .
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,রাসূল (সা) বলেছেনঃ- রামাদানের পরে সবচেয়ে বেশী ফজিলতের সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহাররামের সিয়াম এবং ফরজ সালাতের পরে সর্বাপেক্ষা ফজিলতপূর্ণ সালাত হলো রাতের সালাত(ক্বিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ)।[সহিহ বুখারী]
আশুরার রোজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ
===============================
ما رواه البخاري (1865) عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ فَرَأَى الْيَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ مَا هَذَا ؟ قَالُوا : هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ ، هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى، قَالَ فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ ”
বুখারির বর্ণিত হাদিস (১৮৬৫) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় এলেন তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন তিনি বললেন: কেন তোমরা রোজা রাখ? তারা বলল: এটি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছেন; তাই মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোজা রাখতেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের চেয়ে আমি মুসার অধিক নিকটবর্তী। ফলে তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।”
আশুরার রোজা পালনের নিয়মঃ
=========================
রামাদানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা ফরজ ছিল।কিন্তু যখন রামাদানের রোজা ফরজ হয়ে গেলো তখন আশুরার রোজা ঐচ্ছিক হয়ে যায়। ঐচ্ছিক হলেও এই রোজার গুরুত্ব অত্যধিক,কারণ নবী করীম (সা) কখনোই আশুরার রোজা ছেড়ে দেন নি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে ১০ মুহাররম রোজা পালন করেছেন। কিন্তু ইহুদি ও নাসারারা ১০ মুহাররমকে সম্মান করত এবং এদিন তারা রোজা পালন করত। তাই রাসুল (সা.) তাদের নিয়মের বিপরীত করার জন্য ১০ মুহাররমের সঙ্গে তার আগের অথবা পরের দিনকে যোগ করে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, সুন্নত হলো ৯ ও ১০ মুহাররম কিংবা ১০ ও ১১ মুহাররম রোজা পালন করা।
এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা পালন করলেন এবং সবাইকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ইহুদি নাসারারা এ দিনকে (১০ মহররম) পালন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ মুহাররমসহ রোজা রাখব।’ বর্ণনাকারী বলেন, পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর ওফাত হয়ে যায়। (মুসলিম : ১১৩৪)।
অন্য হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো। তোমরা আশুরার সঙ্গে তার আগের এক দিন অথবা পরে এক দিন রোজা রাখ।’ (সুনানে বাইহাকি, ৪ খ- ২৮৭)। [এই হাদীসটিকে মুহাদ্দীসীনদের কেউ কেউ দুর্বল বলেছেন।
অতএব, সর্বোত্তম হবে ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখা। কারণ, ৯ ও ১০ তারিখে রোজা রাখার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি সহীহ এবং এ ব্যাপারে মুহাদ্দীসীনগণের কোনো দ্বিমত নেই।
√√ নোটঃ
আশুরার রোজা দ্বারা কি ১ বছরের সকল গুণাহ মাফ হয়ে যায়?
এ ব্যাপারে উলামায়ে ক্বেরাম বলেছেন,
تكفير الذنوب الحاصل بصيام يوم عاشوراء المراد به الصغائر ، أما الكبائر فتحتاج إلى توبة خاصة .
قال النووي رحمه الله :
يُكَفِّرُ ( صيام يوم عرفة ) كُلَّ الذُّنُوبِ الصَّغَائِرِ , وَتَقْدِيرُهُ يَغْفِرُ ذُنُوبَهُ كُلَّهَا إلا الْكَبَائِرَ .
وقال شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله : وَتَكْفِيرُ الطَّهَارَةِ , وَالصَّلاةِ , وَصِيَامِ رَمَضَانَ , وَعَرَفَةَ , وَعَاشُورَاءَ لِلصَّغَائِرِ فَقَطْ . الفتاوى الكبرى ج5 .
অর্থাৎ,
আশুরার রোজা দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মার্জনা হবে। কবিরা গুনাহ বিশেষ তওবা ছাড়া মোচন হয় না।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহ মোচন করে।হাদিসের বাণীর মর্ম রূপ হচ্ছে- কবিরা গুনাহ ছাড়া সকল গুনাহ মোচন করে দেয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: পবিত্রতা অর্জন, নামায আদায়, রমজানের রোজা রাখা, আরাফার দিন রোজা রাখা, আশুরার দিন রোজা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সগিরা গুনাহ মোচন হয়।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খণ্ড-৫]
এন-কে