শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি : মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দীর্ঘ ৩৮ বছর পর শতকোটি টাকার ভূমি উদ্ধার করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
বুধবার সকাল থেকে উচ্ছেদ অভিযানে রেল ও জেলা পুলিশের শতাধিক সদস্যের সহায়তায় ২টি বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।
এতে শহরের প্রভাবশালীদের দখলে থাকা ভানুগাছ সড়কের মুক্তিযোদ্ধা কৃষি নার্সারি প্রকল্প, পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট, গ্যাস সিলিন্ডারের গুদাম, ফার্নিচারের শো-রুম, সেলুন, চা পাতার দোকান, বাসাবাড়ি, ভ্যারাইটিজ ষ্টোর, ফার্মেসি, হার্ডওয়্যারের দোকান, ওয়ার্কশপ, ট্রান্সপোর্ট অফিসসহ শতাধিক পাকা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ও ডেপুটি কমিশনার-ঢাকা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুর রহমান মামুন, বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (রেল) মইনুদ্দিন আহমেদ, শ্রীমঙ্গল থানার ওসি (তদন্ত) সোহেল রানা, জিআরপি শ্রীমঙ্গল থানার ওসি আলমগীর হোসেন, রেলওয়ের কানুনগো ইকবাল মাহমুদ, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো শ্রীপদ এসময় উপস্থিত থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম তদারকি করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিকেল ৪টা পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযানে রেলের ২৮৭ শতক জমির উপর বিভিন্ন স্থাপনা সম্পূর্ণ গুড়িয়ে রেলের এসব সম্পত্তি উদ্ধার করা হয়। এসময় ভানুগাছ সড়কের উত্তর-পূর্ব দিক এক প্রকার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এর আগে সকালে শহরের এই অংশের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা উচ্ছেদকালে দ্রুত মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। ভ্যান রিক্সা ট্রাকযোগে মালামাল সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন ব্যবসায়ীরা। এসময় উচ্ছেদ অভিযান দেখতে ভানুগাছ সড়কে বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতা ভীর করেন। এতে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, গত ৩৮ বছর ধরে অবৈধ দখলে ছিল রেলের শতকোটি টাকার ভূমি। এর আগে কয়েকদফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও উদ্ধার করা যায়নি ভূমি। বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন শ্রীমঙ্গল স্টেশন এলাকার ভানুগাছ রোডের পূর্বপাশ সংলগ্ন রূপশপুর মৌজায় জেএল নং ৬৭, খতিয়ান নং-৩, এসএ দাগ-১৭৬১’এ ২৮৭ শতক ভূমি রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একাংশের নাম ভাঙ্গিয়ে এক শ্রেণীর দখলদার শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় ‘কৃষি নার্সারি প্রকল্প’র নামে ১৩৫ শতক ভূমি দখলে নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এছাড়া শহরের শতাধিক প্রভাবশালী একই দাগের ১৫২ শতক ভূমি দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
সূত্র মতে, এই ১৫২ শতক ভূমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। এতে সরকার এখাত থেকে বছরে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।
একটি সূত্র জানায়, সরকারী রাজস্ব বাড়াতে ১৯৮১ সালে টেন্ডারের মাধ্যমে এসব জমিতে ১৮২টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। সে সময় হানিফ ও অপরাপর দখলদারদের করা একটি স্বত্ব মামলার জটিলতায় রেল বিভাগ সেসব প্লটের দখল বুঝিয়ে দিতে পারেনি।
অভিযোগ রয়েছে, দখলদাররা রেলের আইন ও সংশ্লিষ্ট শাখার এক শ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া ও জাল দলিল সৃষ্টি করে ভূমি দখলে নিতে একের পর এক স্বত্ব মামলা করে। এরই মধ্যে এসব মামলা উচ্চ আদালত কর্তৃক খারিজ হয়। ফলে উচ্চ আদালতের রেলের পক্ষে রায় থাকা সত্বেও দখল ধরে রাখতে সামর্থ্য হয়েছিল প্রভাবশালীরা।
জানা গেছে, গত ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা কৃষি নার্সারি প্রকল্পসহ অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রেল বিভাগ এক অভিযান চালায়। এসময় দখলদাররা মুক্তিযোদ্ধা ব্যানার ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সামনে নিয়ে সেই অভিযানে বাঁধা দেয়। বাঁধার মুখে পড়ে রেল বিভাগ অভিযান স্থগিত করে চলে যায়।
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন বলেন, এখানে সাধারণ ব্যবসায়ীরা দোকানকোটা ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেছে। প্রতিটি দোকানে লাখ লাখ টাকার পণ্য আছে। এখানে প্রায় তিন চারশত কোটি টাকার মালামাল ও স্থাপনা ভাঙ্গা হয়েছে। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করবো ব্যবসায়ীদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এই ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়ে ব্যবসা করতেছে। তারা এখন যাবে কোথায়। হঠাৎ করে এ উচ্ছেদ করার ফলে ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছে।
উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে রেলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে রেলের এই ভূমি উদ্ধার করে রাস্তা প্রশস্ত করা ও বাকি ভূমি লিজের আওতায় আনা হবে। ২০১৬ সালের ব্যর্থ উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে অতীতের অনেক ঘটনা আছে, আজকের এই উচ্ছেদের মাধ্যমে আমরা কলঙ্কমুক্ত হতে পারবো।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে রেল লাইন থেকে ৫’শ ফুট পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করা আছে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রভাবশালীরা রেলের অনেক ভূমি দখলে নিয়ে রাখে। বর্তমান সরকার ভূমিগুলো দখলমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করার কাজ করছে। তারই অংশ হিসেবে আজকের এই উচ্ছেদ অভিযান। এই উচ্ছেদটি রেল লাইন থেকে ৫ শত ফুট পর্যন্ত প্রায় ৫ একর জমি হবে তার মধ্যে প্রায় ৩ শতাধিক দোকানপাট হবে। আজকে আমরা প্রথম দিনের মতো উচ্ছেদ করেছি। আগামী দুই দিনে আমরা সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারবো। এরপর আগামী মাসে আমরা আবার এখানে ফিরে আসবো। আমরা চেষ্টা করবো এই জমিটি বাণিজ্যিকভাবে লিজ দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি।