Tag: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

  • অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ

    অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ

    নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার একমাস পূর্ণ করেছে। এই এক মাসে, সরকার প্রশাসনের শীর্ষ পদের ব্যাপক রদবদল এবং বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন— কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সরকার সঠিক পথে এগিয়ে চলছে।

    গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। ওইদিন প্রধান উপদেষ্টা ও ১৩ জন উপদেষ্টা শপথ নেন। পরবর্তীতে আরও তিন দফায় ৭ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়ে, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১।

    নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ থানা আক্রান্ত হয়, পুলিশ বাহিনীতে হতাহত হয় এবং অনেক থানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যদের কর্মবিরতি ও চুরি-ডাকাতির ঘটনার কারণে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটে। তবে সরকারের উদ্যোগে পুলিশ সদস্যদের দাবি মেনে নেওয়া হয়, ফলে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে পুলিশ বাহিনী ফিরে আসে। এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেলেও পুলিশ বাহিনী পুনরায় কার্যক্রম স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।

    সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে গত এক মাসে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানা দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ। ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল এবং চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে তারা সচিবালয় অবরোধ করে। সরকার বাধ্য হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, বিচারপতির বাসভবনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।

    প্রশাসনিক পদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব এবং পররাষ্ট্র সচিবসহ অনেককে অবসর বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তন করা হয়েছে।

    সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা গেছে। অনেক কর্মকর্তা বিক্ষোভ ও চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

    বিচার বিভাগেও পরিবর্তন ঘটেছে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রতিস্থাপন করে নতুন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং নির্বাচন কমিশনও পদত্যাগ করেছে।

    আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেওয়া বিভিন্ন আইনি সুবিধা এবং মামলার রায় নতুন করে পর্যালোচনা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে, এবং তার পরিবারের সদস্যদেরও মামলা করা হচ্ছে।

    বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে হামলা হয়েছে এবং শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে।

    আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ মিলছে এবং গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকার গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে।

    দুর্নীতি দমন এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি আলাদা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

    এছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, যেখানে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

    জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং অন্যান্য আইন সংশোধন করা হয়েছে।

    সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে কিছুটা প্রত্যাশা রয়েছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, জনগণের সহযোগিতা ও ধৈর্য প্রয়োজন, এবং সরকারের তরফ থেকে বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করা হচ্ছে।

    সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সরকার একটি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে এবং ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।

    ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক মাসের মধ্যে সরকারের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।

  • অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন যারা

    অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন যারা

    নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হতে যাচ্ছে।

    বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) রাত ৯টায় বঙ্গভবনে এই মন্ত্রিসভার প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাই শপথ নেবেন বলে জানা গেছে।

    মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাতে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিতে পারেন। তাদের শপথের জন্য বঙ্গভবন প্রস্তুত করা হয়েছে।

    অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা:

    ড. মুহাম্মদ ইউনূস— অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ, শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা।

    অন্তবর্তীকালীন সরকারের ১৬ উপদেষ্টা:

    ১. ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ— বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

    ২. ড. আসিফ নজরুল— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক।

    ৩. আদিলুর রহমান খান— মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা।

    ৪. হাসান আরিফ— সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল।

    ৫. তৌহিদ হোসেন— সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

    ৬. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান— আইনজীবী ও বেলার প্রধান নির্বাহী।

    ৭. মো. নাহিদ ইসলাম— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। তিনি একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

    ৮. আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। তিনি একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

    ৯. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন— সাবেক নির্বাচন কমিশনার।

    ১০. সুপ্রদীপ চাকমা— সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা।

    ১১. ফরিদা আখতার— বিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) এর নির্বাহী পরিচালক

    ১২. বিধান রঞ্জন রায়— জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক।

    ১৩. আ.ফ.ম খালিদ হাসান— হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর।

    ১৪. নূর জাহান বেগম— ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা।

    ১৫. শারমিন মুরশিদ— অধিকার ভিত্তিক সংগঠন ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

    ১৬. ফারুক-ই-আজম, বীর প্রতীক— বীর মুক্তিযোদ্ধা।

    জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় থাক‌বেন। তার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা। ভেতরে আসবাবপত্র নতুনভাবে বসানো হচ্ছে। এই কাজগুলো করছে গণপূর্ত অধিদফতর (পিডব্লিউডি)।

    তবে যমুনা ভবনের সামনে এখনো নিরাপত্তা বেষ্টনী বসানো হয়নি। সেনাবাহিনী, আনসারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।

    উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে এক-এগারোর পট পরিবর্তনের পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ যমুনায় ছি‌লেন।

    ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান তাদের দায়িত্বের দিনগুলো রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যুমনাতেই ছিলেন।