খাবারের ট্রান্স-ফ্যাট হলো ক্ষতিকর চর্বি জাতীয় খাবার। এটি রক্তের ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং খারাপ কোলেস্টরেলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রক্তে অতিরিক্ত মাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই, আপনি যত বেশি ট্রান্স-ফ্যাট খাবেন, আপনার হার্ট এবং রক্তনালি রোগের ঝুঁকিও তত বাড়বে। ট্রান্স-ফ্যাট এত অস্বাস্থ্যকর, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন সংস্থা-এফডিএ সম্প্রতি খাদ্য প্রস্তুতকারীদের খাবার এবং পানীয়তে কৃত্রিম ট্রান্স-ফ্যাটের প্রধান উৎস যোগ করতে নিষেধ করেছে এবং সংস্থাটি আশা করে, এই পদক্ষেপে প্রতি বছর হাজার হাজার হার্ট অ্যাটাক এবং মৃত্যু প্রতিরোধ করবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর ডা. শেখ মাহবুবুস সোবহান এসব তথ্য জানান।
শনিবার (১৪ নভেম্বর) ক্যাব, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, প্রজ্ঞা ও গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর নগরের মোটেল সৈকতের সম্মেলন কক্ষে এ ওরিয়েন্টেশন কর্মশালায় ‘খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট, হৃদরোগ ঝুঁকি এবং করণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি রিসোর্স পারসন হিসেবে বক্তব্য দেন।
ট্রান্স-ফ্যাট কী?
বেশিরভাগ ট্রান্স-ফ্যাট তৈরি হয় শিল্প প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিজ্জ তেল তৈরির সময় তাতে হাইড্রোজেন যুক্ত হয়। এই আংশিক হাইড্রোজেনযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল যা স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায় শক্ত হয়ে যায় সেটিই হলো ট্রান্স-ফ্যাট। এটি খুব বেশি ক্ষতিকর না হলেও খাবার তৈরির সময় উদ্ভিজ্জ তেল পরিবর্তন না করে, ভাজার জন্য বারবার ব্যবহার করলে তা বেশি বেশি ট্রান্স-ফ্যাটে পরিণত হয়, যা শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর।
আপনার খাবারে ট্রান্স-ফ্যাট
নানা রকম বেকারি পণ্য যেমন : কেক, কুকিজ, পিৎজা ট্রান্স-ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম। প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন রকমের খাবার, ফ্রোজেন খাবার এবং নানা ভাজা-পোড়া খাবার, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও ট্রান্স-ফ্যাটের অন্যতম উৎস।
ট্রান্স-ফ্যাট কীভাবে আপনার ক্ষতি করে?
রক্তে যেসব কোলেস্টেরল থাকে, সেগুলোর মধ্যে দু’ধরনের কোলেস্টেরল খুব গুরুত্বপূর্ণ :
*কম ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এলডিএল, যা ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হিসেবে গণ্য। এ ধরনের কোলেস্টেরল হূৎপিণ্ডের রক্তনালির দেওয়ালে চর্বি জমাট বাঁধতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং রক্তনালিগুলো সরু হয়ে রক্ত চলাচলে বাধাগ্রস্ত করে। তাতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
*উচ্চ ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এইচডিএল, যা ‘ভালো’ কোলেস্টেরল। এই কোলেস্টেরল রক্তের ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে যকৃতে বয়ে নিয়ে যায় এবং রক্তনালির দেওয়ালে চর্বি জমতে দেয় না। ট্রান্স-ফ্যাট আপনার রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বা এলডিএল কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল বা এইচডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। এভাবে ট্রান্স-ফ্যাট রক্তের স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রায় অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলে এবং ট্রান্স-ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার হার্ট অ্যাটাক, মস্তিস্কের স্ট্রোক, রক্তনালির অসুখ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
হৃদযন্ত্রের ওপর ট্রান্স ফ্যাটের প্রভাব
উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডব্লিওএইচও’র ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা রক্তে ‘খারাপ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত Low Density Lipoprotei বা এলডিএল বৃদ্ধি করে, অপরদিকে High Density Lipoprotein বা এইচডিএল কোলেস্টেরল (ভালো কোলেস্টেরল বলা হয়) কমিয়ে দেয়। এর ফলে রক্তবাহী ধমনীতে কোলেস্টেরল জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি
ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত দুই শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডগুলোর নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। অন্য একটি গবেষণায় ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগৃহীত ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুটের নমুনায় পাঁচ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
বাংলাদেশে ট্রান্স ফ্যাটের স্বাস্থ্যঝুঁকি
ট্রান্স ফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অতিসম্প্রতি ডব্লিউএইচও প্রকাশিত WHO Report on lobal Trans Fat Elimination ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে যত মানুষ মারা যায়, তার চার দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্স ফ্যাট। ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো আইন বা নীতি নেই, তবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আওতায় এরই মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণে একটি ধারণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।
করণীয়
বাংলাদেশে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী সব ধরনের ফ্যাট, তেল ও খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের দুই শতাংশ নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজন মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্স ফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালিকায় পিএইচও’র মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা ও ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা, যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে এবং ‘ট্রান্স ফ্যাট-মুক্ত’ বা ‘স্বল্পমাত্রার ট্রান্স ফ্যাট’ এ-জাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে হৃদরোগজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু কাক্সিক্ষত মাত্রায় হ্রাস পাবে এবং অসংক্রামক রোগ-সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তিন দশমিক চার অর্জন সহজতর হবে।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রজ্ঞা’র প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাহমুদ আল ইসলাম শিহাব, ভোক্তাদের করণীয় বিষয়ে ক্যাবের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আহম্মদ একরামুল্লাহ আলোচনা করেন।
ক্যাব চট্টগ্রামের সভাপতি এসএম নাজের হোসাইনের সভাপতিত্বে উদ্বোধন পর্বে অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম। সঞ্চালনায় ছিলেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল বাহার ছাবেরী।
আলোচনা শেষে সৈয়দ আলমগীর সবুজকে আহ্বায়ক, হামিদ উল্লাহ ও রেজা মুজাম্মেলকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং প্রীতম দাশকে সদস্য সচিব করে ভোক্তা অধিকার মিডিয়া অ্যালায়েন্স গঠন করা হয়।
২৪ ঘণ্টা/মোরশেদ