খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি : খাগড়াছড়ি শহরে প্রায় দুই দশক ধরেই চলে আসছে, প্রভাবশালী ‘আলম পরিবার’-এর নানামুখী কর্তৃত্ব। রাজনীতি থেকে পরিবহন খাত, টেন্ডার-টোল নিয়ন্ত্রণ থেকে নিলাম আবার আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সকল পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রভাব বলয়। এর বাইরে জেলাশহর ছাপিয়ে উপজেলা পর্যায়ের যেকোন লাভজনক সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনেও এই পরিবারের ঈশারা প্রতিফলিত হতো।
এই প্রভাবের সূচনা হয় এই পরিবারের অন্যতম সদস্য মো: জাহেদুল আলম; জেলা আওয়ামীলীগের সা: সম্পাদক নির্বাচিত হবার সূত্র ধরেই। একই সাথে জাহেদুল আলম, খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগের কল্পরঞ্জন চাকমা এমপি নির্বাচিত হলে ‘আলম পরিবার’-এর প্রতিপত্তি তড়তড় করে বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হলে খাগড়াছড়ি জেলায় এই পরিবারের প্রাধান্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে।
এমনকি ‘২০০১ টু ২০০৬’ সালে বিএনপি-জামাত শাসনামলে এই পরিবার এলাকার বাইরে থেকেও যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করেছে সবকিছু। এরমধ্যে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সরকারের সময়ে পরিবারটির তিন সহোদর জেল-জুলুমও খাটেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিএনপি’র হাতে তাঁরা নিমর্ম নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্ব থেকে তাঁদেরকে খুব বেশি টলাতে পারেনি কেউই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সংসদ সদস্য প্রার্থী যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হন ‘আলম পরিবার’-এর প্রধানতম ব্যক্তি ও জেলা আওয়ামীলীগের সা: সম্পাদক মো: জাহেদুল আলম। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ‘জাতির জনক’ এবং ‘আওয়ামীলীগ ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা’ সর্ম্পকে নানা বিরুপ মন্তব্য করে সমালোচিত হন। দলের শৃঙ্খলা এবং নীতি-আদর্শ পরিপন্থী ভূমিকার দায়ে তিনি প্রথমবার দল থেকে বহিস্কৃত হন। পরে আবার নানা বাস্তবতায় তিনি স্বপদে বহাল হলে আবারও আগের মতোই পরিবারটির প্রভাব উদ্যম নিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান না নেয়ার দায়ে তিনি এবং তাঁর ছোট ভাই দিদারুল আলমসহ দল থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বহিস্কৃত হন। এরপর জেলাশহর এবং বেশ কয়েকটি উপজেলায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সাথে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। টানা প্রায় তিন বছরের রক্তক্ষয়ী হামলা-মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন।
২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ২০১৮ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ‘আলম পরিবার’-এর দিক থেকে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামীলীগ সম্মেলনে সা: সম্পাদকের পদ হারান মো: জাহেদুল আলম। সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর পুর্নগঠিত ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’-এর ১৪ সদস্যের মধ্যেও ওই পরিবারের কারো স্থান মেলেনি। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে ‘আলম পরিবার’-এর সদস্য এবং দুইবারের নির্বাচিত পৌর মেয়র রফিকুল আলম আওয়ামীলীগের মনোয়নবঞ্চিত হন।
দুইবারের মেয়র এবং ‘আলম পরিবার’-এর সর্বশেষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মো: রফিকুল আলম আওয়ামীলীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হবার খবর জানাজানি হলে সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠে। খাগড়াছড়ি শহরের সর্বস্তরের মানুষের মাঝেও এই খবরের নানামুখী প্রতিক্রিয়া চাউর হয়।
সবার ধারণা ছিল, ‘আলম পরিবার’ অতীতের মতো আর মূল দলের বিপরীতে আর অবস্থান নেবেন না। এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল জেলা আওয়ামীলীগের হাইকমান্ডেরও।
তাঁর কারণ হিশেবে জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি মনির হোসেন খান জানান, জেলা সভাপতি এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র নির্দেশনায় কেন্দ্রে প্রস্তাবিত তিন প্রার্থীর তালিকায় মেয়র রফিকের নাম এব নম্বরে দেয়া হয়েছিল। রফিকুল আলম কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন ফরমও কিনেছেন। কিন্তু মনোনয়ন না পেয়ে অতীতের মতো দলের নীতি-আদর্শের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যা তাঁদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক ঐতিহ্য।
আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদটি কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চান না ‘আলম পরিবার’। ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা জানান, জেলা আওয়ামীলীগ থেকে জেলা পরিষদ; সবখানে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সীমিত হয়ে এসেছে। এখন যদি পৌর মেয়রের পদটিও হাতছাড়া হয় তাহলে পরিবারটি নানামুখী চাপে পড়তে পারে। সে আশংকা থেকেই রফিকুল আলম সরকারি দলের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থী হয়েছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আওয়ামীলীগ প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী নিজের জয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, পৌর এলাকার ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ সকল সম্প্রদায়ের মধ্যকার শান্তি ও সহাবস্থানকে আরো সুদৃঢ় এবং আধুনিক পৌরশহর বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন।
বর্তমান মেয়র মো: রফিকুল আলমের বিদ্রোহী প্রার্থী হিশেবে মনোনয়ন দাখিলের প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, যিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তার দায়, তাঁর নিজেরই; দল কোন বিদ্রোহী প্রার্থীর দায় বহন করবে না।
বিএনপি প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল বলেন, ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে ভোটারদের অনাস্থা রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ‘লেভেল প্লেয়িং’ ফিল্ড প্রয়োজন। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে তিনি জয়ী হবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সকালে আওয়ামীলীগের মনোয়ন জমা দেয়ার সময় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর খন্ড খন্ড মিছিলে পুরো শহর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। স্বতস্ফুর্ত মিছিল আর শ্লোগানে নেতাকর্মীরা দৃঢ়তার সাথে জানান, স্বেচ্ছাচারিতা ও নীরব লুঠপাটের বিপরীতে এবারের নির্বাচনে খাগড়াছড়ি পৌরবাসী নির্মলেন্দু চৌধুরী’র মতো সজ্জন নেতাকেই জয়ী করতে ঐক্যবদ্ধ।
২৪ ঘণ্টা/প্রদীপ চৌধুরী