Tag: খালেদা মুক্ত

  • করোনা বিদ্ধ সময় : খালেদা মুক্ত, ইতিহাস গড়লেন মুজিবকন্যা-রিয়াজ হায়দার

    করোনা বিদ্ধ সময় : খালেদা মুক্ত, ইতিহাস গড়লেন মুজিবকন্যা-রিয়াজ হায়দার

    ২৪ ঘন্টা ডট নিউজ। রিয়াজ হায়দার চৌধুরী : সারা বিশ্বের আতঙ্ক-যন্ত্রণা-উদ্বেগের রঙ হয়ে গেল এক’ই। পারমাণবিক কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের কোন যুদ্ধ নয়, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে অণুজীবের যুদ্ধ চালাচ্ছে যেন প্রকৃতি। তাই বিশ্ববাসীর অভিন্ন শত্রুতে পরিণত হলো কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ।

    প্রিন্স চার্লস আক্রান্ত। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রাসাদ ছেড়েছেন । ইতালিতে হাজারে-হাজারে মরছে। ফ্রান্স, স্পেন কিংবা ইউরোপ জুড়ে বা ইরান কিংবা মধ্যপ্রাচ্য অথবা মার্কিন মুলুকের অবস্থা তথৈবচ। প্রকৃতির ভাষাও যেন পাল্টে যাচ্ছে। জীবজন্তুর আচরণেও অসংলগ্নতা স্পষ্ট হচ্ছে । বসন্তের সবুজ যেন ম্লান। মধ্যন্হে ঝাঁক বেঁধে টিয়া পাখির ওড়াউড়ি নজিরবিহীন।

    এই গরমেও মধ্যরাতে কোথাও কোথাও ডাকছে শেয়াল। থেমে থেমে রাতের নৈঃশব্দে চিরচেনা কুকুরের ডাক বন্ধ হয়ে গেছে। রাত্রিতে বিড়ালের পায়চারি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ কিংবা বিশ্ব মানচিত্রে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। প্রতিবেশী ভারতে মোদি বললেন, ২১ দিন বাড়ির বাইরে যেতেই পারবে না কেউ।

    বাধ্যতামূলক ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে মোদি জি’র হুংকার শুধু নয়, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ কিংবা পাশ্চাত্যের ভাষাও কঠোর। বাংলাদেশের অবস্থা কী আরো ভয়াবহ হতে চলছে? দশদিন সরকারি ছুটি পেয়ে ঢাকা,চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহর থেকে লঞ্চে ট্রেনে বাসে;গণপরিবহনে গ্রামে ফেরার যে অপরিণামদর্শিতার ছবি ভাইরাল হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, তাতে স্পষ্ট’ই বুঝা যায় মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে না যে, করোনা ভাইরাস ঠিক কী রকমভাবে ছোঁয়াচে !

    গণমাধ্যমে এসব নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। এমন ঘরে ফেরাকে ‘আত্মঘাতী’ বলছেন , টকশোতে চায়ের পেয়ালায় উঠেছে ঝড়। তবে আমরা কি দেশের মানুষকে বুঝাতে ব্যার্থ হয়েছি? এর দায় নেবে কে ? এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েই সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন, ঠিক সেদিন’ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার মুক্তিতে দলটির নেতাকর্মীরা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

    ২বছর ১মাস ১৬ দিন সাজা কেটে বেগম খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুগ্রহে। এতিমখানা ও দাতব্য সংস্থার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে দোষী সাব্যস্ত বেগম জিয়ার কারাবন্দি সময়ে বিএনপি দফায় দফায় আন্দোলন করলেও কোন সুফল মেলেনি।

    করোনায় সৃষ্ট সঙ্কট মুহূর্তে শেষ পর্যন্ত তার ভাই সাঈদ ইস্কান্দারের আবেদনের পর বোন ও বোনজামাই দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে। বয়স বিবেচনায় মানবিক দিক চিন্তা করে মুক্তির সিদ্ধান্ত দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

    করোনা ঝুঁকি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতাল থেকে শুরু করে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ পর্যন্ত দলে দলে মিছিল করে হুমড়ি খেয়ে কর্মীসমর্থকরা বেগম জিয়ার জন্য তৈরি করলেন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। এনিয়ে খোদ বিএনপিতে প্রশ্ন উঠেছে, যারা এমন হুমড়ি খেলেন, একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, তাঁরা মোটেও ভালো চাননি।

    গণস্বাস্থ্যের ডাঃ জাফরুল্লাহ অবশ্য বললেন, এক্ষেত্রে সরকার দায় এড়াতে পারে না। সরকার কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্বটি নিশ্চিত করতে পারতেন। কঠোরভাবে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। বন্দীদশা শেষে মুক্তির বিষয়টি বিএনপির দায়িত্বশীল শীর্ষ নেতারা তাৎক্ষণিক সরকারকে প্রশংসা না করলেও বিলম্বে হলেও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কেউ কেউ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

    বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকার সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস স্বীকার করেই বলেছেন, ‘এখানে আমাদের কোন কৃতিত্ব নেই, ম্যাডামের পরিবারের সদস্যদের কৃতিত্ব ছাড়া।’ করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দন্ড প্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশটি যে মানবিক, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও এ নিয়ে চলতি মারি ও মড়কের দিনে রাজনৈতিক আলোচনা হতেই পারে।

    সবছাপিয়ে এ কথায় সত্য যে, বাংলাদেশ জন্মের পরের ইতিহাসে কোন প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারপ্রধানের মানবিকতার ক্ষেত্রে এটি অনন্য নজির। শুধু তাই নয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় রাজপথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা মামলার সাক্ষ্যপর্বে যেখানে সাফ করেই সাক্ষীরা ঘটনাটির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার দিকেই অভিযুগের আঙুল তুলেছিলেন, সেই অভিযুক্তকেই মুক্তি দিয়ে নেতৃত্বের উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

    সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসেও সমুজ্জল। তবে যে দেশে জাতির পিতার মর্মান্তিক বিয়োগের দিনে জন্মদিন পালনের বিতর্কিত রেওয়াজ প্রচলিত, সে দেশে দিবস উদযাপনের প্রতিযোগিতার ভীড়ে এই ‘কারামুক্তি দিবস’টি বেগম জিয়া ও বিএনপি’র জন্য হবে বড়ই অস্বস্তির ।

    কেননা, স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের এই দিনে ২৫ মার্চের কালরাত্রির দুঃসহ স্মৃতিই বাঙালি বয়ে বেড়াবে অনাদিকাল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ঠিক এক’ই দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে করোনার বিরুদ্ধে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

    তিনি বললেন, ‘ঘরে বসেই এ যুদ্ধ জয় করুন। মাত্র ১৪ দিন আলাদা থাকুন। নিজের ও নিজের পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের নিরাপদ রাখুন। দুর্যোগের সময় মনুষ্যত্বের পরীক্ষা হয়। মজুদদারদারদের সতর্কবার্তা, ৫হাজার কোটি টাকার ‘বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী চলতি দুর্যোগে কার্যত একটি ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। মনোবল অটুট রাখা, নির্দেশনা পালনের জন্যও বলেন ।

    প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনতার যে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধজয়ের কথাটিও মনে করিয়ে দিলেন। তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সঙ্গে ‘সরবরাহ চেইন’ অব্যাহত রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি করবেন না । অতিরিক্ত কোনো ভোগ্য পণ্য কিনবেন না। মজুদ করবেন না।

    প্রধানমন্ত্রীর এমন দৃঢ় ঘোষণার বিপরীতে পাড়ার মুদি দোকানেও ‘পেনিক বাই’ এর প্রভাব। খাদ্যপণ্যের আকাল পরিস্থিতি তৈরি করছেন কিছু লোভাতুর মজুদদার-স্বার্থান্ধ মানুষ। এপরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তৃতার কথা মনে পড়ে খুব। লোভি চক্র ও মজুদদার, লুটেরা শ্রেণীর অপতৎপরতারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের মিলিটারি একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে স্পষ্টই বলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে ওরা অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

    মজুতদার ঘুষখোর চোরাকারবারিদের তিন বছর ধরে আমি কঠোর বার্তা দিয়েছি। আমি শপথ করেছি, ওদের নির্মূল করবো। আপনারাও শপথ করুন ।

    পুনশ্চ: এই বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও আশাবাদ জাগায় কক্সবাজারের সহযোদ্ধা সাংবাদিক আহমেদ গিয়াসের তথ্য। গিয়াস জানালেন একজন সাফিয়ার কথা। একজন রত্নগর্ভা মা’র কন্যা সাফিয়া। মা কক্সবাজার জেলার প্রথম করোনা রোগী। মা’র এমন দুর্দিনে ভয়ে পালাচ্ছেন সবাই। আত্মীয়স্বজন-চিকিৎসক-নার্স, এমনকি হাসপাতালের অন্য রোগীরাও আতংকগ্রস্ত।

    রোগী হাসপাতাল ছেড়েও পালিয়েছেন। জরুরী বিভাগেও কমেছে রোগী। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মায়ের পাশে আছেন মাত্র একজন। মেয়ে সাফিয়া। মানুষের সাথে প্রকৃতির এই যুদ্ধে মানবতার অবিচল দুঃসাহসী সাফিয়াদের এখন বড় বেশি প্রয়োজন।

    (লেখক: সহ-সভাপতি, বিএফইউজে- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাধারণ সম্পাদক, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রাম) 

    ২৪ ঘন্টা/ আর এস পি