উগ্রবাদে দীক্ষিত হওয়ার লক্ষণগুলো ও কেউ দীক্ষিত হলে তার সমাধানের ব্যবস্থা সম্পর্কে সবাইকে জানাতে, সরকারের বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে সংলাপ করা জরুরি।
সেলক্ষ্যে ঢাকা মহানগরে আজ থেকে শুরু হলো ‘ঢাকা পিস টক’ কর্মসূচি। ১২ টি রাউন্ড টেবিল ১২টি বিষয়বস্তু নিয়ে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে বলে জানান ‘ঢাকা পিস টক’ কর্মসূচির আয়োজক সেন্ট্রার ফর সোশ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড রিসার্স ফাউন্ডেশন (সিসার্ফ)।
আজ (১৯ অক্টোবর) সকাল ১১টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে উগ্রবাদ নির্মূলে সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিসার্ফ) উদ্যোগে ‘ঢাকা পিস টক’ নামে একটি কর্মসূচী উদ্বোধন সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এ কর্মসূচীতে সার্বিক সহযোগিতা করবে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এবং অর্থায়ন করছে ইউএসএআইডি।
এই কর্মসূচি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মোঃ মনিরুল ইসলাম।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিসার্ফ এর প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শবনম আজীমসহ ইউএসএইড এর প্রতিনিধি ও সংবাদ মাধ্যমের বিশিষ্ট্য জনেরা।
‘ঢাকা পিস টক’ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ হলেও বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে পড়েছে। সহিংস উগ্রবাদ বিরোধী কার্যক্রম একটি লংটার্ম প্রসেস। উগ্রবাদ দমনে শুধু পুলিশই নয়, পরিবার, সিভিল সোসাইটিসহ সকলের সম্মিলিত প্রয়াস থাকতে হবে। সিটিটিসি উগ্রবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করছে, মামলার তদন্ত করছে। পাশাপাশি উগ্রবাদে প্রিভেন্টিভ উদ্যোগ হিসেবে ঢাকা পিস টক কাজ করবে বলে জানান তিনি।
২৫-৩০ বছর বয়সী যুবকরাই উগ্রবাদে জড়িত হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, উগ্রবাদ একটি মতবাদ, এটিকে রুখতে পাল্টা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি হিসেবে কাজ করবে।
ঢাকা পিস টকের মতো কার্যক্রম ঢাকার বাইরে শুরু করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা পিস টক নামে একটি প্রোগ্রাম ঢাকায় চালু হচ্ছে। ঢাকায় সাকসেসফুল হলে দেশের অন্য কোথাও চালুর চিন্তা করা হবে। এ ধরনের কার্যক্রম আরো বেশি আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, হলি আর্টিজান পরবর্তি সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গত কয়েক বছরে সন্ত্রাসবাদ কমে যাওয়ায় এ কার্যক্রম কমে গেছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের ঝুঁকি কমে যায়নি, এটা রিয়াল থ্রেট। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আরো সুসংহতভাবে কাজ করবে ঢাকা পিস টক। আমরা ১২টি রাউন্ড টেবিল মিটিংয়ে ২৫জন করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধিকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করব। আমাদের বিশ্বাস তাঁরা এখান থেকে উগ্রবাদ বা সহিংস উগ্রবাদ মোকাবেলার শিক্ষা নিয়ে সমাজে সোশ্যাল এ্যাম্বাসিডর হিসেবে কাজ করবে।
সম্প্রতি গ্রেফতার জঙ্গিদের বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে, কেউ নতুন করে জড়িয়েছে। বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠির ইন্টারনেটে লুকরেটিভ এবং এট্রাকটিভ প্যাকেজ থেকে তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। যাদের মধ্যে দেশপ্রেম কম, দায়িত্ববোধ নেই, মতাদর্শে দূর্বল, যারা বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেনা এবং মানষিকভাবে দূর্বল তরুণরাই নতুন করে রেডিকালাইজড হচ্ছে।
সিসার্ফ এর প্রধান শবনম আজীম এই কর্মসূচীর মূল্য উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলেন, সেন্ট্রার ফর সোশ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড রিসার্স ফাউন্ডেশন (সিসার্ফ) একটি অলাভজনক থিংকট্যাংক, যেটি সামাজিক অ্যাডভোকেসি, গবেষণা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে থাকে। এটি বাংলাদেশে অনেক দিন থেকে কাজ করছে। একদল গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দক্ষ সাংবাদিকের সমম্বয়ে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি কৌশলগত চিন্তক ও অ্যাকাডেমিকদের একটি প্ল্যাটফর্ম। বর্তমান বিশ্বে সহিংস উগ্রবাদ বা মতাদর্শিক সহিংসতা, এমন এক নতুন সংকট, যার আঁচ আমাদেরও লাগছে, যা সাধারণ কোনো আইন-শৃংখলা সংকট নয়, আমরা সবাই তা জানি, বুঝি, মানি। কিন্তু কেউ তলিয়ে দেখি না, সমস্যাটার প্রকৃতি কী। বৈশ্বিকভাবে মতাদর্শিক সহিংসতার নানান মাত্রা ও রূপ আছে। এটা মোকাবেলা করা সহজ নয়, কারণ একটা বিশেষ সমাজের কাঠামো, মূল্যবোধ – এরকম নানান বিষয় এর সঙ্গে জড়িত।
এসব চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় না নিয়ে মতাদর্শিক সহিংসতা প্রতিরোধের কোনো কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনে না। শুধু যে ধর্মীয় উন্মাদনার কারণেই সহিংস উগ্রবাদের ঘটনা ঘটছে তা কিন্তু নয়। নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনাও এর জন্য দায়ী। কী কারণে আমাদের তরুণরা সহিংস উগ্রবাদী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে আরও বেশি করে অনুসন্ধান করতে হবে।
পরিসংখ্যান বলে তরুণরাই সহিংস উগ্রবাদে বেশি ঝোঁকে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো জাতি। কোনো শিক্ষার্থী যাতে উগ্রবাদে জড়াতে না পারে, সেজন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দরকার পরিবারভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তারপর সামাজিক পরিবেশে ও সবশেষে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই উগ্রবাদ বিরোধী মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।
গবেষণার ফল বলে উগ্রবাদ সৃষ্টির কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই। কেননা একেক পরিস্থিতিতে একেকভাবে উগ্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কোনও ছকেই এই উগ্রবাদকে সরলীকরণ করা যাবে না। সহিংস উগ্রবাদ বা এর ঘনীভূত রূপ সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিল কাজ কোন সুনির্দিষ্ট বাহিনী, সংস্থা ও ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না।
যদি মতাদর্শিক সহিংসতা মোকাবেলা করতে হয়, তাহলে এর প্রকৃতি বুঝতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে এর চালকগুলোকে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কিছু হবে না। যদি কোনো পরিকল্পনা তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে ভূক্তভোগীদেরও তাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঢাকা পিস টক সেরকমই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন অ্যাপ্রোচ তৈরির উদ্যোগ। এটি ইউএসএইড-এর অবিরোধ: রোড টু টলারেন্স প্রোগ্রামের সহায়তায় বাস্তবায়ন করবে সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন বা সিসার্ফ। আর এই যাত্রাপথের সার্বিক সহায়ক হবে কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
যে কারণগুলো মানুষকে উগ্রবাদের পথে নিয়ে যায়, সিসার্ফ ‘ঢাকা পিস টকের মাধ্যমে সেগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি শুধু সমস্যা নির্ণয় নয়, এসবের সমাধানের পথও দেখাবে। প্রথমে সমাজের ৩৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকের একটি প্যানেল তৈরি করা হবে। এরপর ১২টি ইস্যুতে অনুষ্ঠেয় ডায়ালগে অংশগ্রহণ করবে অভিভাবক, শিক্ষক, বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠনের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, সরকারি প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক এনজিও, থিংক ট্যাংক, নারী নেত্রী, সিভিল সোসাইটি সংগঠন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, আদিবাসী গ্রুপ, তরুণসমাজ, লেখক, ব্লগারসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিরা।
যেসব বিষয় নিয়ে সেমিনারে আলোচনা হবে সেগুলো হলো: মতাদর্শিক সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবার ও উন্নত অভিভাবকত্ব, শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচি পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধ, তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে রেডিক্যালাইজেশন প্রতিরোধে জাতীয় নীতি প্রণয়ন, উগ্রবাদ প্রতিরোধে নারীর ভূমিকা, উগ্রবাদী জড়িতদের সামাজিক পুনর্বাসন, শান্তির পথে আন্তঃধর্ম সমন্বয়, উগ্রবাদের খবর পরিবেশনে গণমাধ্যমের ভূমিকা, উগ্রবাদ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঝুঁকি প্রবণতা, আগামীতে করণীয় ইত্যাদি।
মোটকথা উগ্রবাদ বিষয়ে একটি সামগ্রিক বিশদ রূপরেখা নিয়ে এগোতে চায় সিসার্ফ। সমাজের সকল পক্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি একমাত্র কৌশল। ঢাকা পিস টক এই লক্ষ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক ধাপ।