আমাদের ঘরবাড়ি এখনও পানিতে ডুবে আছে। সিলেট প্রতিনিধিঃ পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে, যা ছিল সবকিছু পানি নিয়ে গেছে। না খেয়েই দিন পার করছি। সাহায্য-সহযোগিতায় নিয়ে কেউ আসছে না, পানি আরও কয়েকদিন থাকবে। কিভাবে দিন যাবে ভেবে পাচ্ছিনা। গত ১০০ বছরেও এত পানি এলাকার কেউ দেখেনি।
রবিবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিলাজুর গ্রামের এরশাদ মিয়া ও আব্দুল কাইয়ুম এভাবেই নিজেদের কথা জানিয়েছেন।
জলযানের সংকটের কারণে সিলেটের বন্যাদুর্গত সব জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।
ভয়াবহ বন্যায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জ, তবে রবিবার থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় শনিবার রাতে এসেছে বিদ্যুৎ। তবে নগরের ১০ থেকে ১৫টি এলাকায় পানি না নামায় বিদ্যুৎহীন রয়েছে। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। ফলে পানিবন্দী অবস্থায় না খেয়েই দিন পার করছেন অনেক মানুষ।
এখনও সারাদেশের সাথে বিচ্ছিন্ন সুনামগঞ্জ। জেলার বিভিন্ন উপজেলা সড়ক ও বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে রয়েছে। গত চারদিন ধরে সুনামগঞ্জে নেই বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোথায় কোথায় আবার আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা সংকট রয়েছে। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। জেলার প্রতিটি বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। হয়েছে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি। এখনো ৪ থেকে ৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে সুনামগঞ্জ শহর। হাসপাতাল, দোকানপাট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব জায়গায় পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের নেই কোনো সুযোগ। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি মানুষ।
এদিকে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও বাড়তে শুরু করেছে দুর্ভোগ ও বন্যার রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন। তবে এবারের বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামছে বলে জানিয়েছেন বন্যার্তরা। বন্যার্তদের উদ্ধারে কাজ করেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার সেচ্ছাসেবকরা।
সরেজমিনে রবিবার দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার হাইটেকপার্কের সড়কে বর্নি, তেলিখাল, বিলাজুর, আঙ্গুরাকান্দি গ্রামের মানুষজন অভিযোগ করেছেন- রবিবার পর্য়ন্ত তাদের গ্রামগুলোতে কোনো প্রকার সহায়তা আসেনি। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন কয়েকদিন ধরে। বন্যায় শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘরবাড়ি, ধান, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি। পানির স্রোতে ভেসে গেছে নিজেদের ঘর। এখনও অনেকের ঘরবাড়ি রয়েছে পানির নিচে, এসব ঘরবাড়ি আছে কি নাই তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। সবমিলেয়ে বন্যায় কারণে নি:স্ব হয়ে গেছেন তারা। এছাড়াও রবিবার পর্যন্ত সিলেট-সুনামগঞ্জের কোনো কোনো এলাকায় পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। এসব এলাকাতে তৈরি হয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়। অনেকেই না খেয়ে পানিবন্ধী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। টানা চারদিন ধরে পানিবন্ধী হয়ে থাকলেও পাননি কোনো ধরনের সহায়তা। তাছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না ঠিকমতো খারার।
বিকেলে সরেজমিনে সিলেট নগরের সোবহানীঘাট, যতরপুর, উপশহর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, সাদাটিকর, তেরোরতন, মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, কালীঘাট ও তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, লামাপাড়, বেতেরবাজার, ঘাসিটুলা, বাগবাড়ি, শেখঘাট, টিকরপাড়া, কুয়ারপার, কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি দেখা গেছে।
সিলেট জেলা শহরের সাথে সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পানি। এর আগে গত ১৫ মে থেকে সিলেট নগর ও ১৩টি উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছিল। এতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল গ্রামের হান্নান মিয়া জানান, গত ৩দিন ধরে পানিবন্ধী হয়ে আছি, এখনও কেউ ত্রাণ বা কোনো সহায়তা নিয়ে আসেনি। আমাদের বাড়িঘর পানির নিচে, আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।
বর্নি গ্রামের বাসিন্দা দিলোয়ার জানান- পুরো ঘর ডুবে গিয়েছিল, এখন ঘরের ভেতরে কোমর পানি রয়েছে। আমাদের ধান, গুরুসহ ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র শেষ হয়ে গেছে। তবে আমরা এখনও কোনো সরকারি সহয়োগিতা পাইনি।
একই উপজেলার আাঙ্গুরাকান্দি গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় দাস জানান, গত ৩দিন ধরে হাইর্টেক পার্কের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে উঠেছি। আমাদের ঘরবাড়িতে এখন পানি, বার বার বন্যার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। গত বন্যার চেয়ে এবারের বন্যার পানি ৬ ফুট বেশি হবে।
সিলেট নগরের কাজিরবাজারের ব্যবসায়ী ও শেখঘাটের স্থায়ী বাসিন্দা দিপু আহমদ জানান, গত কয়েকদিন ধরে পানির জন্য ব্যবসা বন্ধ রয়েছে, আমাদের বাসায় নেই বিদ্যুৎ, রয়েছে পানি। চরম ভোগান্তিতে রয়েছি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় সরকার পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে। নতুন করে সিলেটের জন্য আরও ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, জলযানের সংকটে সব জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় প্রশাসন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।