নিলয় ধর,যশোর প্রতিনিধি:- যশোর মনিরামপুরে সরকারি চাউল আটক কান্ডে জড়িত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এবার চাষীদের কাছ থেকে কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য ফাঁস হয়েছে।
২ হাজার ৫শত ২৯ মে:টন আমন ধান সংগ্রহের নামে কমিশন বাবদ কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেটটি।
আর কমিশনের এ টাকা আদায়ের মূল দায়িত্ব পালন করেন সিন্ডিকেট সদস্য ও চাউল কান্ডে অভিযুক্ত জুড়ানপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নৈশ্য প্রহরী জগদিশ দাসসহ কয়েকজন।
অভিযোগ করা রয়েছে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করতো ১ জন জনপ্রতিনিধি। তবে চাউল পাচারকান্ডের পর প্রশাসনের বেশ তৎপরতার কারনে জগদিশসহ সিন্ডিকেটের অধিকাংশরাই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রন মামুন হোসেন খান জানান, মনিরামপুরে আমন ধান সংগ্রহ করা হয়েয়ে ১ হাজার ৪০ টাকা মন দরে ৬৩ হাজার ২২৫ মন (দুই হাজার ৫২৯ মে:টন)। কৃষি অফিসের প্রস্তুতকৃত চাষীর তালিকা থেকে লটারীর মাধ্যমে চুড়ান্ত করা হয় ২ হাজার ১৫০ জনকে। প্রতি চাষীর কাছ থেকে ১ থেকে দেড় মে:টন ধান সংগ্রহের উদ্বোধন করা হয় গত বছর ১২ ডিসেম্বর। আর সংগ্রহ শেষ হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে।
নিয়ম রয়েছে কার্ডধারি যেসব চাষীরা আমন চাষ করেছেন শুধুমাত্র সেই সব চাষিদের নাম ক্রয় তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার।
কিন্তু কৃষি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি অফিসারেরা সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করেই এক প্রকার গোজামিল দিয়ে তড়িঘড়ি করে তালিকা প্রস্তুত করায় ভূয়া নামের ছড়াছড়ি হয়। বাদ পড়ে প্রকৃত চাষীরা।
কিন্তু ঢালাও এই অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা কৃষি অফিসার হীরক কুমার তরফদার জানিয়েছেন, প্রথম দিকে কিছু গরমিল হলেও পরবর্তিতে তা নিরসন করা হয়। কিন্তু চুড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করতে আমন মৌসুম প্রায় শেষ হয়ে যায়। ফলে অধিকাশ চাষীদের ঘরে তখন ধান ছিলোনা। এ সুযোগে মধ্যস্বত্তভোগী এ সিন্ডিকেট চাষীদের কাছ থেকে কৃষিকার্ড সংগ্রহ শুরু করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিন্ডিকেটের এক সদস্য জানান, চাষীদের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন সিন্ডিকেটের সদস্য জুড়ানপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নৈশ্য প্রহরী জগদিশ দাস। আর জগদিশকে এ কাজে সহায়তা করতেন তার গুরুখ্যাত চাতাল মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক অষ্টম দাস।
এছাড়াও একাজে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত দেবাশীষ দাস, চৈতন্য দাস, শহিদুলসহ বেশ কয়েকজন। এরা চাষীদের বিভিন্ন প্রলোভন ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কৃষিকার্ড সংগ্রহের পর নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর আদায় করতেন। পরবর্তিতে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাজার থেকে কম মূল্যে (ছয়’শ টাকা মন প্রতি) ধান ক্রয়ের পর ওই সব কৃষিকার্ড এবং স্বাক্ষর করা ফরম নিয়ে সরকারি খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করেন।
আবার অনেকের কাছ থেকে মন প্রতি দুই থেকে ৩শত টাকা নিয়ে ধান দেওয়ার জন্য কৃষি কার্ড বিক্রি করতেন। সব মিলিয়ে আমন ধান থেকে এই সিন্ডিকেট কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নেয়।
কমিশনের এই টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সিন্ডিকেটের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে ঠান্ডা বিরোধও দেখা দেয়। সিন্ডিকেটের অপর এক সদস্য জানান, মূলত: এ বিরোধকে কেন্দ্র করেই গত ৪ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে পুলিশ ভাই ভাই রাইস মিলে অভিযান চালিয়ে সরকারি ৫৪৯ বস্তা চালসহ আটক করে চাতাল মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং ট্রাক চালক ফরিদ হাওলাদারকে।
অবশ্য এসময় সেখানে চাতাল মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন উপজেলা চেয়ারম্যান,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,পুলিশ, সাংবাদিকসহ উপস্থিতিদের সামনে চাল পাচারের ঘটনায় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসিএলএসডি), প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা(পিআইও), সিন্ডিকেট নেতা শহিদুল ইসলাম, অষ্টম দাস, জগদিশ দাসসহ জড়িত অনেক কুশিলবদের নাম প্রকাশ করে।
অথচ অজ্ঞাত কারনে পুলিশ বাদি হয়ে শুধুমাত্র চাতাল মালিক মামুন এবং ট্রাকচালক ফরিদের নামে মামলা করেন।
পুলিশ (৫ এপ্রিল) মামুন এবং ফরিদকে আদালত দুই দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে (৭ এপ্রিল) তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সম্পা বসুর আদালতে ১৬৪ ধারা মোতাবেক মামুন এবং ফরিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
জবানবন্দিতে তারা উল্লেখ করেছেন, চাউল পাচারের ঘটনায় তাদের সাথে আরো জড়িত ছিলেন সিন্ডিকেট নেতা শহিদুল ইসলাম, জগদিশ দাসসহ ২ জন সরকারি কর্মকর্তা। অবশ্য উপজেলা চেয়ারম্যান নাজমা খানম পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তি বাচ্চুর বিরুদ্ধে সরকারি চাল পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। পরদিন উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুও উল্টো চেয়ারম্যানকে ঈঙ্গিত করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এক পর্যায়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য ২১ এপ্রিল যশোর ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মামুনের স্বীকারোক্তি মোতাবেক চাউল পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ মে রাতে ডিবি পুলিশের একটি টিম পৌরশহর থেকে সিন্ডিকেট নেতা শহিদুল ইসলামকে আটক করে।
পরে শহিদুল ইসলাম আদালতে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সরকারি চাল পাচারের ঘটনায় তার সাথে জড়িত ছিলেন উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক ও ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তি বাচ্চু এবং পাতন-জুড়ারপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি যুবলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস।
তবে এ অভিযোগকে অনেকেই দলীয় এবং সিন্ডিকেটের ভাগবাটোয়ার কোন্দলের ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
অপরদিকে সিন্ডিকেটের প্রধান আদায়কারি জুড়ানপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী জগদিশ দাসকে পুলিশ এখনও পর্যন্ত আটক করতে পারেনি। তাকে আটক করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আরো বড় বড় রুই কাতলার নাম বেরিয়ে আসবে বলে অভিজ্ঞমহলের দাবি।
তবে সরকারি ৫৪৯ বস্তা চাউল পাচারকান্ড মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা যশোর ডিবি পুলিশের ওসি মারুফ আহম্মেদ দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের জানান, সরকারি চাল পাচার ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।
২৪ ঘণ্টা/এম আর