Tag: মোহাম্মদপুরের সুলতান

  • দিনমজুর থেকে ‘মোহাম্মদপুরের সুলতান’

    দিনমজুর থেকে ‘মোহাম্মদপুরের সুলতান’

    ছিলেন দিনমজুর। বহু কষ্টে জমানো টাকায় খুলে বসেছিলেন একটা টং দোকানও। তারপর খুব দ্রুত বদলে গেল সবকিছু।

    দিনমজুর সেই লোকটিই রাতারাতি হয়ে গেল বিলাসবহুল বাড়ি আর গাড়ির মালিক।

    ছয় বছর আগে একমাত্র বাহন অল্প দামি একটি মোটরসাইকেল থাকলেও ছয় বছর শেষে হয়েছে কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি। কিছুদিন পরপরই তিনি পরিবর্তন করেন গাড়ির ব্র্যান্ড। যেখানেই যান, তার গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকে শতাধিক সহযোগীর একটি দল। নিজের সংগ্রহে রয়েছে মার্সিডিস, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টসসহ নামিদামি সব ব্র্যান্ডের গাড়ি।

    এই হলো কাউন্সিলর তারিকুজ্জামান রাজীবের গল্প। রাজীবের গল্পটা শুনে মনে হতেই পারে যে, সে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়েই ধনী হয়ে গেছে। কিন্তু গল্প আর বাস্তব এক নয়। তবে গল্পের সাথে বাস্তবের কিছু মিল থেকেই যায়।

    রাজীবের আলাদীনের প্রদীপ না থাকলেও ছিল প্রদীপের দৈত্যের মতো বিশাল রাজনৈতিক গডফাদার। মূলত এই গডফাদারদের জোরেই টং দোকানদার থেকে মোহাম্মদপুরের `সুলতান’ হতে পেরেছিল রাজীব।

    দামি ব্র্যন্ডের গাড়িতে চড়তেন রাজীব

    জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে যুবলীগ দিয়েই শুরু রাজীবের রাজনৈতিক জীবন। মাত্র এক বছরের রাজনীতি করেই বাগিয়ে নেয় মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়কের পদ। এ পদ পেয়েই থানা আওয়ামী লীগের এক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করে। সে সময় যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। শোনা যায়, রাজীব মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে উল্টো ঢাকা মহানগরী উত্তর যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বনে যায়। এই পদ কিনতে সে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ করেছিল বলে জানা যায়।

    ২০১৪ সালে কাউন্সিলর হওয়ার পর মাত্র কয়েক বছরেই রাজীব কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। শোনা যায়, কাউন্সিলর নির্বাচন করার আগে রাজনীতির পাশাপাশি এক চাচাকে কাজকর্মে সহযোগিতা করতো সে। ওই চাচা ঠিকাদারি করতেন। নির্বাচনের সময় তার ওই চাচা একটি জমি বিক্রি করে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে রাজীবকে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে সহযোগিতা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ওই চাচার সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে রাজীব।

    মাত্র ছয় বছর আগেও মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাড়ির নিচতলার গ্যারেজের পাশেই ছোট্ট এক বাড়িতে ৬ হাজার টাকায় সস্ত্রীক ভাড়া থাকত রাজীব।

    মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর প্লটে রয়েছে রাজীবের ডুপ্লেক্স বাড়ি। জানা গেছে, ৫ কাঠা জমির ওপর বাড়িটি করতে খরচ হয়েছে ৬ কোটি টাকা। এর বাইরে রহিম ব্যাপারী ঘাট মসজিদের সামনে আবদুুল হক নামে এক ব্যক্তির ৩৫ কাঠার একটি প্লট যুবলীগের কার্যালয়ের নামে দখল, ওই জমির পাশেই জাকির হোসেনের ৭-৮ কাঠার ১টি প্লট দখল করেছিলেন। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ময়ূর ভিলার মালিক রফিক মিয়ার কয়েক কোটি টাকা দামের জমি দখল করেন রাজীব। পাবলিক টয়লেট নির্মাণের মাধ্যমে জমিটি দখল করলেও সেখানে ৫টি দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন। ঢাকা রিয়েল এস্টেটের ৩ নম্বর সড়কের ৫৬ নম্বর প্লট, চাঁদ উদ্যানের ৩ নম্বর সড়কের রহিমা আক্তার রাহি, বাবুল ও জসিমের ৩টি প্লটসহ অন্তত ১০টি প্লট দখল করেছেন তিনি। বিদেশেও আছে অঢেল সম্পত্তি।

    জানা গেছে, রাজীবের আয়ের মূল উৎস হলো সরকারি জায়গা দখল করে ভাড়া দেওয়া, জমি দখল, তদ্বির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনো ব্যবসা।

    রাজীবের সব অপকর্মের সঙ্গী যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবন, সিএনজি কামাল, আশিকুজ্জামান রনি, ফারুক, রাজীবের স্ত্রীর বড় ভাই ইমতিহান হোসেন ইমতিসহ অর্ধশত ক্যাডার। অভিযোগ রয়েছে, রাজীবের নির্দেশেই যুবলীগ কর্মী তছিরকে হত্যা করে রাজীবের ঘনিষ্ঠরা।

    ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে রাজীব ছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। বিভিন্ন কারসাজি করে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারায় সে।

    অভিযোগ রয়েছে, এর পর থেকেই এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নানাভাবে অপমান অপদস্থ করে আসছিল সে।

    মোহাম্মদপুরের পুরো নিয়ন্ত্রণই চলে গিয়েছিল তার হাতে। মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলার পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং অটোরিকশা, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলে তার লোকজন। পাঁচ বছর ধরে এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারাও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল রাজীব।

    সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর সে অন্তত ২০০ কোটি টাকা খরচ করে তার গ্রেপ্তার আটকাতে চেয়েছিল বলে দাবি করেছে একটি সূত্র।

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত চেষ্টাই বিফলে গেল।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদপুর-বসিলা-ঢাকা উদ্যানসহ আশপাশ এলাকার অঘোষিত সম্রাট রাজীবের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। দিনমজুর থেকে চাঁদাবাজি ও দখলের টাকায় ধনকুবের হয়ে ওঠা রাজীব গতকাল ভাটারা থেকে আটক হয়েছেন র‌্যাবের হাতে। ওই বাড়িতে রাজীব ১৩ অক্টোবর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন। বাড়িটি তার আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধুর।