আবদুল্লাহ আল নোমানের জানাজায় মানুষের ঢল

স্মরণকালের আরেকটি বড় জানাজার সাক্ষী হলো চট্টগ্রামের মানুষ। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমানের নামাজে জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকে দূর-দূরান্তের মানুষ আসতে থাকেন জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে। মানুষের সব স্রোত এসে মিশে দামপাড়ায়। কারও হাতে ফুলের তোড়া, বুকে শোকের কালো ব্যাজ।দেখতে দেখতে মসজিদ কমপ্লেক্স ভরে যায় মুসল্লিতে। মাঠও কানায় কানায় ভরে যায় জুমার নামাজের আগে।
দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো অনেকে জননন্দিত রাজনীতিক, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের মুখটি দেখেন।
শুক্রবার জুমার পরে চট্টগ্রামে আবদুল্লাহ আল নোমানের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, জামায়াতের মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরী, বিএনপি উত্তর জেলা আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, মাহবুবের রহমান শামীম, মীর মোহাম্মদ হেলাল, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, আবুল হাশেম বক্কর, মরহুমের ছেলে সাঈদ আল নোমান, জাতীয় পার্টির সোলায়মান আলম শেঠ, আনজুমানে রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
প্রয়াতের পরিবারের তরফে একমাত্র ছেলে সাঈদ আল নোমান তূর্য বলেন, “আমার বাবার রাজনৈতিক জীবন ৬৮ বছরের। আমার এই জীবনে যত মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ কখনো না কখনো বলেছে, তারা নোমান ভাইয়ের দ্বারা কোনো না কোনো উপকার পেয়েছেন। কীভাবে তা জানি না!
“মাত্র ২ বার তিনি মন্ত্রী ছিলেন। এত স্বল্প সময়ে এত মানুষের কাজ কীভাবে করেছেন, আমি জানি না।”
নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেষ জীবনে বিএনপি নেতা নোমানের যে ফোনালাপ হতো, তা তুলে ধরতে গিয়ে ছেলে তূর্য বলেন, “আমি পাশে থাকতাম, তাই জানি। তিনি বলতেন, ‘আমি নোমান, আবদুল্লাহ আল নোমান, ক্যান আছো? (কেমন আছো?) আমার সাথে মন খারাপ করেছ?’
“বলতেন, ‘নিশ্চয় আমার কোনো দোষ ছিল, না হলে কেন মন খারাপ হবে আমার উপর?’ অন্য কেউ যে তার প্রতি কোন দোষ করতে পারে, সেটা কখনো বলতেন না। অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। কখনো নিজের ক্রেডিট নিতেন না।”
সাঈদ আল নোমান বলেন, “বাবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তখন লালদীঘিতে প্রথম বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার চট্টগ্রামে’। কর্ণফুলী তৃতীয় সেতুর জন্য বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। এই মসজিদকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বরাদ্দ এনেছিলেন। উনার প্রস্তাবনায় বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন ১৬ দফা দিয়ে।
“তিনি চাইতেন, আমাদের দুই ভাইবোনের দ্বারা যেন শুধু মানুষের সেবা হয়। সেবা ছাড়া আর কিছু নয়। আপনারা সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন।”
নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেষ জীবনে বিএনপি নেতা নোমানের যে ফোনালাপ হতো, তা তুলে ধরতে গিয়ে ছেলে তূর্য বলেন, “আমি পাশে থাকতাম, তাই জানি। তিনি বলতেন, ‘আমি নোমান, আবদুল্লাহ আল নোমান, ক্যান আছো? (কেমন আছো?) আমার সাথে মন খারাপ করেছ?’
“বলতেন, ‘নিশ্চয় আমার কোনো দোষ ছিল, না হলে কেন মন খারাপ হবে আমার উপর?’ অন্য কেউ যে তার প্রতি কোন দোষ করতে পারে, সেটা কখনো বলতেন না। অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। কখনো নিজের ক্রেডিট নিতেন না।”
সাঈদ আল নোমান বলেন, “বাবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তখন লালদীঘিতে প্রথম বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার চট্টগ্রামে’। কর্ণফুলী তৃতীয় সেতুর জন্য বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। এই মসজিদকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বরাদ্দ এনেছিলেন। উনার প্রস্তাবনায় বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন ১৬ দফা দিয়ে।
“তিনি চাইতেন, আমাদের দুই ভাইবোনের দ্বারা যেন শুধু মানুষের সেবা হয়। সেবা ছাড়া আর কিছু নয়। আপনারা সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন।”
স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি সভাপতি শাহ আলম বলেন, “নোমান ভাইয়ের সাথে একসঙ্গে গ্রেপ্তার হই ১৯৬৮ সালে। এরপর ৮ মাস জেলে ছিলাম আমরা। কত স্মৃতি। উনি যেন জান্নাতবাসী হন।”
বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, “উনার সাথে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছি, উনার দিক নির্দেশনায়। আজ এমন একজন নেতাকে হারিয়ে পুরো বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, “গণমানুষের নেতা নোমান ভাই দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চলে গেছেন। চট্টগ্রামের স্বার্থে উনি অনেক কিছু করেছেন।
“তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু, শিক্ষা বোর্ড, এই জমিয়তুল ফালাহর উন্নয়নসহ অনেক কাজ তিনি করে গেছেন।”
চট্টগ্রাম উত্তর জেলার আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, “’৬৯ এ একসাথে আন্দোলন করেছি। সেই থেকে তিনি আমার নেতা। ব্যক্তি হিসেবে সমাজে সাধারণ মানৃষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক নেতা তিনি। “উনার কর্মময় জীবন যেন নেতাকর্মীরা অনুসরণ করেন।”
স্মৃতিচারণায় অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহসহ নেতারা।
এর আগে, বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয় নাসিমন ভবনে শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় আবদুল্লাহ আল নোমানের মরদেহ। সেখানে চট্টগ্রামের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ঢল নামে।
এতে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আবদুল্লাহ আল নোমান একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। উনি সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। নোমান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনীতি করেছি। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে, আন্দোলন, সংগ্রামে রাজপথে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই নাসিমন ভবনে পুলিশের আক্রমণ, টিয়ার গ্যাসের শিকার হয়ে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। নোমান ভাই ছাত্ররাজনীতি করেছেন, শ্রমিক রাজনীতি করেছেন, বিএনপির রাজনীতি করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংগঠিত করার জন্য চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর, দক্ষিণসহ এই অঞ্চল এবং যেখানেই দলের ডাক দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে সেখানে ছুটে গেছেন। ওনার রক্তের সঙ্গে রাজনীতি মিশে গেছে। নোমান ভাইয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামের রাজনীতি ও কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক স্মৃতি আছে। সুখ-দুঃখ, ভালো-খারাপ সময় আমরা অতিক্রম করেছি।’
এ সময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আমীর খসরু বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা যে আপসহীন রাজনীতি, দীর্ঘ সময় আত্মত্যাগের মাধ্যমে, জীবন দিয়ে, গুম হয়ে, খুন হয়ে, জেলে গিয়ে, চাকরি হারিয়ে, ব্যবসা হারিয়ে যে ত্যাগের রাজনীতি বিশেষ করে গত ১৬ বছর রোদে পুড়ে আমরা খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছি। এটা বিএনপির সম্পদ। এ সম্পদ কেউ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমরা যে ত্যাগের মাধ্যমে পরিণত হয়েছি এটা পরিপূর্ণ ও পরিণত রাজনীতি। সেখানে নোমান ভাইয়ের অবদান ছিল।’
নামাজে জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি রাউজান উপজেলার গহিরায়। রাউজান গহিরা হাইস্কুল মাঠে বাদ আসর মরহুমের শেষ নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৬টায় রাজধানীর ধানমন্ডির বাসায় অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি ইন্তেকাল করেন আবদুল্লাহ আল নোমান (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। ঢাকায় তিন দফা নামাজে জানাজা শেষে বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল পৌনে ৫টার দিকে হেলিকপ্টারে মরদেহ চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে আনা হয়। এরপর কাজীর দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারের বাসভবন প্রাঙ্গণে নেতাকর্মী ও স্বজনদের দেখার জন্য মরদেহ রাখা হয়।
১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম নেওয়া নোমান একসময় বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন, কারাবরণও করেন।
মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
ছাত্রজীবন শেষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে নোমান যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। গোপনে ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন। ১৯৭০ সালে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন।
১৯৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে ন্যাপের রাজনীতিতে তার পথ চলা। এরপর ১৯৮১ সালে যোগ দেন বিএনপিতে।
১৯৯১ ও ২০০১ সালে চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নোমান। খালেদা জিয়ার দুই সরকারের আমলে মৎস্য ও পশু সম্পদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বন ও পরিবেশ এবং খাদ্য মন্ত্রণায়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব তিনি পালন করেন।
আপনার মতামত লিখুন