জব্দ করা ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে মানচিত্র, বিতর্কে বিজিবি

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কুষ্টিয়ায় জব্দ করা ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র বানিয়েছে। এ ঘটনার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় সমালোচনা ও বিতর্ক।
মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়ার মিরপুরে ‘৪৭ বিজিবি’ জব্দকৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংসের অনুষ্ঠানে এ কাণ্ড ঘটায়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জব্দকৃত ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রের আদলে একটি প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। প্রতিকৃতির ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হলে তা দ্রুত ভাইরাল হয়।
বিজিবি’র পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করা হলেও বিশিষ্টজনরা সমালোচনা করে বলছেন, অজ্ঞতা ও দেশপ্রেমের বোধ যাদের নেই তারাই এমনটা করতে পারে। জাতীয় মর্যাদাকে যারা লাঞ্ছিত করে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আইন তৈরি করে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা দরকার।
৪ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন সময়ে ৪৭ বিজিবি’র আটক করা ১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকার মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়েছে। ওই দিন দুপুরে জেলার মিরপুরে ৪৭ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের (বিজিবি) অভ্যন্তরে এসব মাদকদ্রব্য ধ্বংস করে। এর আগে আটক মাদকদ্রব্য (ফেনসিডিলের বোতল) দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করা হয়।
এর আগে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আটক করা বিপুল পরিমাণ মদ ও ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কুষ্টিয়া সেক্টর। মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই এমনটা করা হয়েছে বলে দাবি তাদের।
তবে মঙ্গলবারের এমন ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে বিজিবি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম কতোটা যুক্তিসংগত, এমন প্রশ্নও তোলা হয় সেখানে। এমন কাজের জন্য দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে বলেও লেখেন তারা।
জীবন রহমান মোহন নামের এক ব্যক্তি নিজের পোস্টে লিখেছেন: ‘অবৈধ ফেনসিডিল দিয়ে দেশের মানচিত্র, সেটা কোন যুক্তিতে করলো বিজিবি আমার মাথায় আসে না। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের বাংলাদেশের মানচিত্র। কুষ্টিয়ার মিরপুর মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিজিবি ক্যাম্প কর্তৃক মাদকদ্রব্য ধ্বংসের পূর্বে ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র বানানোর যৌক্তিকতা কি দেখাবেন কুষ্টিয়া মিরপুর বিজিবি ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ? এমন ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ড দেশের মানচিত্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে কিনা? একটা মানচিত্র মানে একটা দেশ, একটা সার্বভৌমত্ব, সেই দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে এমন তামাশা বাংলাদেশের মানচিত্রের অবমাননার শামিল।’
মো. আকবর হুসেন লিখেছেন: ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করলো ফেন্সিডিলের বোতল দিয়ে!’
আ. রহমান চৌধুরী তুহিন লিখেছেন, ‘চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে…মানচিত্রে এক বিন্দু জায়গাও খালি নাই, প্রতিটি কোনায় কোনায় মাদক দখল করে ফেলেছে!!! ফেনসিডিল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র…!!!’
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মতো বিশিষ্টজনরাও বিজিবি’র এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন: বিজিবি অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ করেছে। এটা করার বুদ্ধি তাদের কে দিয়েছে? আমাদের মনে রাখতে হবে, এ মানচিত্র আমরা অর্জন করেছি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে। পৃথিবীর কোনো জাতি স্বাধীনতার জন্য এতো মূল্য দেয়নি যা আমরা দিয়েছি।
তিনি বলেন: আমরা মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে এমন তামাশা বরদাশত করা উচিত না।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং ‘৭৫-এর প্রতিরোধী যোদ্ধা বীরপ্রতীক সরদার নাজিমুদ্দিন আহমেদ গেরিলা বলেন: এমন কর্মকাণ্ড কাণ্ডজ্ঞানহীন, অজ্ঞতা ও অবজ্ঞার ব্যাপার। যাদের দেশপ্রেমের বোধটুকু নেই তারাই এ ধরনের কাজ করতে পারে।
‘দেশের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, মমত্ববোধ থাকতে হয়’ জানিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন: দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে ঠিকই। কিন্তু উন্নয়নকে ধরে রাখার জন্য যে মজবুত কাঠামো দরকার সেটা আমাদের তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন: দেশকে অসম্মান করে, দেশের প্রতি ভালোবাসাকে বহি:প্রকাশের জন্য আমরা বিকৃত কর্মকাণ্ড করি তাহলে আমাদের ষোলোআনাই মিছে হয়ে দাঁড়াবে।
ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র নির্মাণ করায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন: দেশের মানচিত্রকে, দেশের জাতীয় পতাকাকে, দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে যারা অশ্রদ্ধা করে তাদের শাস্তির জন্য বিশেষ আইন তৈরি করা দরকার।
জাতীয় মর্যাদাকে অবমাননা করা হয় এমন বিষয়ে বিশেষ আইন করার প্রস্তাব ২০১৬ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি করেছে। সংস্থাটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন: মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস ও অস্বীকার আইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাবটা আমরা আইন কমিশনকে লিখিতভাবে দিয়েছি। পরে তারা খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
তিনি বলেন: এই আইনে আমাদের জাতীয় মর্যাদাকে কেউ যদি অবমাননা, লাঞ্ছিত ও অবমূল্যায়ন করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এ ধরনের কাজ যারা করেছে তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শামিল অপরাধ করেছে জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন: আমরা বারবার আইন মন্ত্রণালয়কে বলছি আইনটি দ্রুত পাশ করার জন্য। আইনটি বাস্তবায়ন হলে অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে।
ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে মানচিত্র তৈরির বিষয়ে বিজিবি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন ও প্রশিক্ষণ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার ফরিদ হাসানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে বিজিবি’র জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন: বিষয়টি ভুলে করা হয়েছে। এমন ভুলের জন্য বিজিবি দুঃখপ্রকাশ করছে।
আপনার মতামত লিখুন