যাত্রামোহনের বাড়ি রক্ষায় প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা’

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি রক্ষায় প্রয়োজনে আইনি পথে যাওয়ার কথা বলছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা।
সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানানো হয়। চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রড়ড় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে ঐতিহাসিক ভবনটি রক্ষায় তিনদফা দাবিও জানানো হয় প্রশাসনের কাছে।
সংবাদ সম্মেলনে কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন সংবিধানের ২৪ ধারা উল্লেখ করে বলেন, “ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে। যাত্রামোহন সেনগুপ্তর বাড়িটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবন। এ ধরনের যেসব ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ নিয়ে আইনও আছে।”
চট্টগ্রাম আদালত ভবন রক্ষার সময়ে এই যুক্তিতে মামলা করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রয়োজনে যাত্রামোহন সেনগুপ্তর এই ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষায় আমরা মামলায় যাব। এটির সুরক্ষা করা রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের কর্তব্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র উদাসীনতা দেখিয়েছে বলে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।”
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে সোমবার ওই বাড়িটি ভাঙার হাত থেকে রক্ষা পায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে জমি ইজারা নিয়ে ওই ভবনে এখন একটি বিদ্যালয় চলছিল। আদালতের আদেশের কথা বলে সোমবার ফরিদ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বুলডোজার নিয়ে সদলবলে এসে বাড়িটি ভেঙে ফেলতে গিয়েছিলেন।
প্রতিরোধের মুখে জেলা প্রশাসন এসে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সিলগালা করে জানায়, এ ভবনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
‘অপকৌশলে’ এই জমিটির বিষয়ে আদালতের আদেশ আনা হয়েছে বলে দাবি করে রানা দাশগুপ্ত বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। যতীন্দ্র মোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছু দিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি।
আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আন্দোলন এবং ব্রিটিশি বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িতে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এসেছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্র মোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল তার। এরপর নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধের পর ফিরে দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে।
১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি লিজ বা ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে। ১৯৭৫ এর পর নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছেন।
বাড়িটি রক্ষার দাবিতে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র আয়োজিত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি সাংবাদিক আলীউর রহমান সরকারের কাছে তিন দফা দাবি পেশ করেন।
এগুলো হচ্ছে- যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তা’র সম্পত্তি নিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে তা দেশের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে বাতিল ঘোষণা করা; চট্টগ্রাম জেলা যুগ্ম জজের প্রথম আদালত থেকে দেওয়া আদেশ এবং উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসকে না জানিয়ে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি দখল করতে পুলিশি তৎপরতার যথাযথ তদন্ত করা; অর্পিত সম্পত্তি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে ঐতিহাসিক ভবনটি অক্ষত রেখে পেছনে বহুতল ভবন তৈরি করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন স্মৃতি জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা।
সংবাদ সম্মেলনে টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, “যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তার বাড়িটি দখল করে সেখানে বাংলা কলেজ ও পরবর্তীতে সেখানে শিশুবাগ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা অন্যায় হয়েছে। ঐতিহাসিক সেই ভবনকে সরকার ইজারা দিয়ে অন্যায় করেছে। এরপর এখন আরেকপক্ষ এসে নিজেদের মালিক দাবি করে সেটা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে, সেটাও অন্যায়।
“ভবনটি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। আমরা চাই না সেটি হারিয়ে যাক। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ভবনটি সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার দাবি করছি।”
আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, “অতীতেও চট্টগ্রাম আদালত ভবন, রেলস্টেশন, সিআরবি নিয়ে আমরা এই পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ সেই ভবনগুলোও ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। আমরা পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম গঠন করে সেদিন এই অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের প্রতিবাদ যৌক্তিক হওয়ায় সরকার সেই ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
“আমরা সরকারের কাছে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, পাবনায় সুচিত্রা সেনের ভিটেমাটি যেভাবে সরকার অধিগ্রহণ করে সেটাকে স্মৃতি সংগ্রহশালা করেছে, একই আদলে এই ভবনটিও রক্ষা করা হোক। অন্যথায় আইনি প্রক্রিয়ায় যেভাবে চট্টগ্রাম আদালত ভবন আমরা রক্ষা করেছি, একই পদক্ষেপ এক্ষেত্রেও গ্রহণে আমরা পিছপা হব না।”
জাল নথি তৈরি করে বাড়িটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “বাড়িটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে গণ্য আছে। জেলা প্রশাসক এর কাস্টডিয়ান কিন্তু মালিক নন। দখলদার ফরিদ উদ্দিনের পক্ষে আদালতের আদেশের যে নথি দেখানো হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে মিলন সেনগুপ্ত বনাম ফরিদ। যে জমির মালিক মিলন সেনগুপ্ত নন, বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি কিভাবে পক্ষভুক্ত হন? উনার তো বিক্রির কোনো আইনগত অধিকারই নেই। জাল দলিল সৃজন করে আদালতকে বিভ্রান্ত করে তারা একটা আদেশ এনেছেন, যেটা অবৈধ।’’
সাংবাদিক আলীউর রহমান বলেন, “দখলদার ফরিদ উদ্দিন একজন ভূমিদস্যু। আমরা জানতে পেরেছি, উনি সারাদিন আদালত ভবনে ঘোরাঘুরি করেন। উনার কাজ হচ্ছে জাল দলিল সৃজন করে সম্পত্তি দখল করা এবং নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা।”
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে, সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, আইনজীবী সুভাষ চন্দ্র লালা, শিল্পী শাহরিয়ার খালেদ প্রমুখ।
আপনার মতামত লিখুন